বেশ কয়েক মাসের দলীয় কোন্দলের পর অসম্মানিত, অপমানিত হয়ে শনিবার চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফাই দিয়ে দিলেন তিনি। সেইসঙ্গে ক্ষোভ উগরে দিলেন হাইকম্যান্ডের প্রতি। নভজ্যোত সিং সিধুকে নিয়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের মাখামাখিতে প্রচণ্ড বিরক্ত তিনি। আর কয়েক মাস পরেই পাঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে ক্যাপ্টেনের ইস্তফার মাশুল দিতে হতে পারে কংগ্রেসকে। একবার দেখে নেওয়া যাক, যে পাঁচটি কারণে সরে যেতে হল ক্যাপ্টেনকে।
অপবিত্রতা, মাদক কাণ্ডে ব্যবস্থা না নেওয়া এবং বাদল
শিরোমণি অকালি দলকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসার আগে কংগ্রেস পাঞ্জাবকে মাদকের জাল থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এছাড়া অপবিত্রতা মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিল। কিন্তু চার বছর পেরোলেও অপবিত্রতা মামলা ঝুলে রয়েছে। গত এপ্রিলে পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্ট প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদলকে কোটকাপুরা পুলিশ ফায়ারিং মামলায় ক্লিনচিট দেয়। বারগারি গ্রামে শিখ ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবের পাতা ছিঁড়ে ফেলার প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামবাসীরা। তাতেই ২০১৫ সালে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়ে কয়েকজনের। ২০১৯ সালে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর নভজ্যোত সিং সিধু এই নিয়ে ক্যাপ্টেন সরকারের তুমুল নিন্দা করেন তদন্তে ঢিলেমির জন্য। পরে তা খারিজ হয়ে যায় হাইকোর্টে।
২০১৭ সালে অমরিন্দর সরকার বিচারপতি রঞ্জিথ সিং কমিশন গঠন করে। সেই কমিশন অপবিত্রতা মামলায় সাফ জানায়, বাদলরা ডেরা সাচা সৌদাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কোনও কারণেই হোক, বাদলদের উপর নরম ছিলেন ক্যাপ্টেন। মাদকের বাড়বাড়ন্ত নিয়েও একপ্রকার নিষ্ক্রিয় ছিল সরকার। ক্ষমতায় আসার একমাসের মধ্যে মাদকের জাল সরিয়ে দেবেন বলেছিলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু ছোটখাটো অপরাধীরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা এখনও অধরা।
ধরাছোঁয়ার বাইরে ক্যাপ্টেন
কংগ্রেস বিধায়কদের বরাবরই অভিযোগ ছিল, মুখ্যমন্ত্রী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সহজে তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায় না। ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যেই থাকতেন মুখ্যমন্ত্রী। আর আগেও মেয়াদকালেও এমন অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এবার যেন আরও বেশি বেড়ে যায় তাঁর এই অভ্যাস। এমনকী চণ্ডীগড়ে পাঞ্জাব সচিবালয়েও যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। ক্যাপ্টেন শহরে ছেড়ে ফার্মহাউসে থাকতে শুরু করেন। তাঁর এই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাঁটা ফেলে। আগে পাঞ্জাববাসীরা সঙ্গত দর্শন করতেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। অকালিরাও করতেন, কংগ্রেসের বিয়ন্ত সিংও করেছেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন তার ধার ধারেননি।
আমলাতন্ত্রে বেশি নির্ভরতা
রাজ্যের সমস্ত কংগ্রেস বিধায়ক-সাংসদরা একটাই অভিযোগে বেশি সরব ছিলেন, সরকার বড্ড বেশি আমলাতান্ত্রিক। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় এসেই ক্যাপ্টেন ১৯৮৩ ব্যাচের আইএএস ক্যাডেট সুরেশ কুমারকে মুখ্যসচিব নিযুক্ত করেন। কিন্তু তাঁর নিয়োগকে হাইকোর্ট বাতিল করে দেয় আর কুমারও পদত্যাগ করেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ইস্তফা গ্রহণ না করে সরকারের তরফে হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করতে থাকেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অনেকেই দেখেছেন, সুরেশ কুমার ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে ছিলেন। শাসকদলের বিধায়করা সরব ছিলেন, তাঁদের কথা শোনা হচ্ছে না।
বাইরের সমীক্ষা
ক্যাপ্টেনে এবং তাঁর সরকারি নিয়ে বাইরের সংস্থা দিয়ে পাঞ্জাবে সমীক্ষা করায় কংগ্রেস। তাতে দেখা যায়, মুখ্যমন্ত্রীর জনপ্রিয়তায় মরচে ধরেছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে তাঁর কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় ফেরা অসম্ভব বলেই সমীক্ষায় উঠে আসে। প্রশান্ত কিশোর এবং আইপ্যাক এই কারণেই দূরত্ব তৈরি করে ক্যাপ্টেন সরকারের কাছ থেকে।
নম্বরের খেলা
প্রদেশ সভাপতি হওয়ার পর সিধু এবং তাঁর অনুগামী তিন মন্ত্রী ত্রিপ্ত রাজিন্দর সিং বাজওয়া, সুখবিন্দর সারকারিয়া এবং সুখজিন্দর রানধাওয়া, কৌশলে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিংহভাগ বিধায়কদের নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করেন। নানা সময়ে ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখিয়ে হাইকম্যান্ডকে চিঠি-চাপাটি করতে থাকেন। এমনকী সনিয়া-সাক্ষাতেরও দাবি জানাতে থাকেন। ঝামেলা থামাতে তাই সিধুকে প্রদেশ সভাপতি করে কংগ্রেস। কিন্তু তাতেও বিদ্রোহ কমেনি। গত বুধবার ৪০ জনেরও বেশি বিধায়ক এবং চার মন্ত্রী সনিয়াকে পরিষদীয় দলের বৈঠকের আবেদন করে ক্যাপ্টেন সরকারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন। হাইকম্যান্ডও ক্যাপ্টেনকে সরে যেতে নির্দেশ দেয়। বাধ্য হয়ে লজ্জিত, অপমানিত ক্যাপ্টেনের ইস্তফা দেওয়া ছাড়া আরও কোনও পথ ছিল না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন