দেশের ১৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন দ্রৌপদী মুর্মু। তিনিই দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি, এবং মহিলা রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দ্বিতীয়। শপথের পর তাঁর ভাষণে তিনি ওড়িশার একটি ছোট আদিবাসী গ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের পৌঁছানোর প্রসঙ্গ টানেন। আদিবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকার কথাও মনে করিয়ে দেন। চার বার বিদ্রোহ করেছিলেন আদিবাসীরা, যা স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। বলেন দ্রৌপদী। আমরা সেই চার আদিবাসী বিদ্রোহের দিকে একটু নজর দিয়ে দেব।
সাঁওতাল বিদ্রোহ
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ১০ হাজারের বেশি সাঁওতাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের হুঙ্কার দিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে কানহো মুর্মু, চাঁদ মুর্মু, ভৈরব মুর্মু, এবং সিদহো মুর্মু। যদিও আমরা সিদহো এবং কানহোকে সিধু কানু বলে থাকি, একেবারে ঘরের ছেলের মতো করে। জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ ছিল। বিদ্রোহ সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধেও, যারা জোর করে কর আদায়ের নিরিখে জমিদার-মহাজনদের থেকেও এক কাঠি বেশি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত গোটা ব্যবস্থাটা চলছিল দুর্নীতি এবং নিপীড়নে ভর করে। বিদ্রোহ তারই বিরুদ্ধে।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুন, যে তারিখের কথা শুরুতেই বললাম, ভাগনাদিহির মাঠে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ১০ হাজারের বেশি সাঁওতাল জড়ো হয়েছিলেন। সেখানেই, টইটম্বুর সভায় সিধু-কানুরা বিদ্রোহের ডাক দেন। সাঁওতালের হুল শুরু হয়। বনের আগুনের মতো যা ছড়িয়ে পড়ে। নানা সাঁওতাল গ্রাম বিদ্রোহে ফুটতে থাকে। সাঁওতালদের ঢল নেমে যায় আন্দোলন-যোগে। এক অদ্ভুত তরঙ্গ, এখনও রক্ত গরম করে তোলে। প্রথম দিকে বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল ভাগলপুর ও আশপাশ। প্রবল ক্ষোভে যেন সব জ্বলছিল আর ছড়াচ্ছিল।
সাঁওতালরা নীলকর সাহেব পাউটেটকে হত্যা করলেন, রাজমহল ও ভাগলপুরের মধ্যে যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হল। সরকারের ডাক চলাচল বন্ধ হল, অন্য সরকারি কাজকর্মেও বসে গেল বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। ইংরেজ সেনা বিদ্রোহ রুদ্ধ করতে নেমে পড়ল। সাঁওতালরা তীর-বল্লমে প্রতিরোধ করতে লাগলেন। এবং বিদ্রোহ আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকল। গোদা, পাকুড়, মহেশপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের নানা জায়গায় ছড়াল। জমিদার-মহাজনরা এলাকা ছেড়ে পালাতে থাকেন। বহু অঞ্চল হয়ে গেল ইংরেজ শাসনমুক্ত, মুক্তাঞ্চল।
আরও পড়ুন Explained: রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, জানুন তাঁর উত্তরণের কাহিনি
যদিও একটা সময় ইংরেজের সঙ্গে লড়াইয়ে এই বিদ্রোহ পিছনের পায়ে সরতে থাকল। আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে তিরধনুকের লড়াই! বহু সাঁওতাল গ্রাম খাক করে দেওয়া হল, চলল সাঁওতাল-হত্যা। নির্বিচারে। ক্রমে আট মাসের বিদ্রোহের শেষ হল সিধু-কানু-চাঁদের মৃত্যুতে। পরাজিত, তবে অসীম গৌরব। উজ্জ্বল। আজও।
পাইক বিদ্রোহ
১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বিদ্রোহ। পাইক বিদ্রোহকে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। ওড়িশার সেই সময়ের খুরদা রাজ্যে এই বিদ্রোহের কাহিনিটি জন্ম নিয়েছিল। তার পর ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। কী ভাবে এই বিদ্রোহের শুরু?
খুরদা রাজের নিয়োগ করা সেনাকর্মীদের পাইক বলা হত। তাঁরা যে জমি ভোগ করতেন তা ছিল নিষ্কর, এবং ছিল পদের অলঙ্কার, অহঙ্কারও। এক কথায় তাঁদের ছিল বেশ মানসম্মান, প্রতিপত্তি। ব্রিটিশরা খুরদার রাজা দ্বিতীয় মুকুন্দ দেবকে পরাস্ত করার পর, ১৮০৩ সালে সে রাজ্যের দখল নিল। তার পর যে ভূভাগকে ওড়িশা ডিভিশনের সঙ্গে জোড়া হয়েছিল। পরাজিত রাজা দ্বিতীয় মুকুন্দ দেবকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুরীতে। রাজা থেকে তিনি ইংরেজের অধীনে এক জমিদার হয়ে গেলেন। যদিও তিনি পুরী মন্দিরের নিয়ন্ত্রক হয়েছিলেন তার পর, ইংরেজের বদান্যতায়। এদিকে পাইকাররা সব কিছু হারাল। না রইল কোনও সম্মান, উপরন্তু তাঁদের থেকে জমির করও আদায় করা হতে থাকল। ইংরেজ নিজেদের সেনাবাহিনীতে তাঁদের কোনও স্থানই দিল না। কেনই বা দেবে!
এই ভাবে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন তৈরি হয়েছিল, যা বাইরে এল একটি ঘটনায়। ঘুমসুরের খোন্ধ আদিবাসীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিলেন। ঘুমসুর থেকে খুরদায় এসেই এই বিদ্রোহ তাঁদের। এবার, বক্সি জগবন্ধু বিদ্যাধর মহাপাত্র ভ্রমরবরা রায়া, যাঁকে বক্সি জগবন্ধু বলা হত, যিনি আগে ছিলেন খুরদার সেনাপতি, তাঁর নেতৃত্বে পাইকাররা বিদ্রোহী আদিবাসীদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তার পর, বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। বানাপুরে সরকারি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হল, পুলিশ কর্মীকে মারা হল, সরকারি তহবিল লুঠ করা হল, বহু ব্রিটিশ অফিসারকেও নিকেশ করা হল। পাল্টা এল, যেমনটা স্বাভাবিক। বক্সি জগবন্ধু পালালেন জঙ্গলে, ১৮২৫ পর্যন্ত অধরা রইলেন। ধরা পড়ার পর জেলে পোরা হল তাঁকে। চার বছর কাটতে না কাটতে বক্সি জগবন্ধুর মৃত্যু হল।
কোল বিদ্রোহ
ছোটনাগপুর, সিংভূম, রাঁচি, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলের আদিবাসীরা কোল নামে পরিচিত। ১৮৩১ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যৌথ মালিকানার বদলের ব্যক্তি মালিকানা চালু করেছিল ইংরেজরা। এর বিরুদ্ধে কোলরা ফুঁসে উঠেছিলেন। বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা, সিংরাই মানকিরা হলেন বিদ্রোহীদের নেতা। রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, মানভূমের ছড়িয়ে পড়েছিল এই বিদ্রোহ। তাঁদের নিজ-ভূমি থেকে মহাজন বা দিকু, জমিদার, জোতদার ও ইংরেজ কর্মচারীদের উৎখাত করাই ছিল লক্ষ্য। ১৮৩৩ সালে ক্যাপ্টেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে বাহিনী কোল বিদ্রোহের দমনে করে।
ভিল বিদ্রোহ
মহারাষ্ট্রের খান্দেশে যখন ইংরেজরা ঢুকল, তখন সেখানকার আদিবাসী ভিলরা চটে উঠলেন। তাঁরা ইংরেজদের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ ছিলেন। তাদের নিয়মকানুন মেনে নেননি। ইংরেজরা তাঁদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, তাঁদের উপর সব কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে, এসব তাঁরা মানবেনই বা কেন! ১৮১৮ সালে এই বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। ইংরেজরা এই বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু তার পরেও ভিলরা কিন্তু ফুঁসে ওঠেছে, অনাচারের বিরুদ্ধে। যেমন রাজস্থানে মাড়োয়ারি মহাজনদের বিরুদ্ধেও ভিলরা কোমর বাঁধে। অনেক মহাজন পগাড় পারও হয়েছিল ভিলের ভয়ে।