Advertisment

'গুমনামি' কীভাবে নেতাজি মৃত্যু তত্ত্বগুলিকে ফের আলোচনায় নিয়ে এল?

দেড় দশকের গবেষণালব্ধ এই বইয়ে তাঁরা দাবি করেন, বিমান দুর্ঘটনার পর স্বাধীন ভারতে নেতাজি জীবিত অবস্থায় ছিলেন এবং তাঁরা নেতাজি অন্তর্ধান সম্পর্কিত তৃতীয় তত্ত্বটিকে সমর্থন জানান।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
How ‘Gumnaami’ has resurrected the theories of Subhas Chandra Bose’s death

আইএনও রেজিমেন্টে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। ফাইল ছবি।

স্বাধীনতার পরও উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে বেঁচে থাকা গুমনামি বাবাই কি ছদ্দবেশী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু? সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিনেমা 'গুমনামি' সম্প্রতি এ বিষয়েই জোরালো বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গুমনামি বাবা রূপে নেতাজির চরিত্রায়নে প্রবল আপত্তি জানিয়েছেন বসু পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের মতে, এই ধরনের সিনেমা তৈরি করা মানে আদপে নেতাজিকে চূড়ান্ত অপমান করা। বসু পরবারের বহু সদস্যই মনে করেন, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইপের তাইহোকু বিমানবন্দরের নিকটে এক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে নেতাজির।

Advertisment

তবে যতই বিতর্ক দানা বাঁধুক, পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, তিনি সিনেমায় নেতাজির অন্তর্ধান সম্পর্কিত তিনটি তত্ত্বকেই স্থান দিয়েছেন। সিনেমাটি ২৮ অগাস্ট সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের (সিবিএফসি) ছাড়পত্র পেয়েছে বলেও জানিয়েছেন পরিচালক। ৪ অক্টোবরের ছবিটি মুক্তি পেতে চলেছে।

আরও পড়ুন- পাকিস্তানের আকাশপথ ভারতের জন্য নিষিদ্ধ হলে কী হবে?

প্রসঙ্গত, নেতাজি অন্তর্ধান সম্পর্কিত তিনটি তত্ত্বই আলোচনায় উঠে আসে। বিভিন্ন তদন্ত ও বিতর্কে এই তিন তত্ত্বই বিশেষভাবে আলোচিত হয়। অনেকেই বলে থাকেন এবং বিশ্বাস করেন যে ১৯৪৫ সালে তাইপে বিমান দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরেই নেতাজির মৃত্যু ঘটেছিল। তবে, দ্বিতীয় তত্ত্বটি আবার বলে, নেতাজিকে আটক করে রাশিয়ার কারাগারে হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৪৬ সালের ২৫ জুলাই গোয়েন্দা আধিকারিক কর্নেল (পর্বর্তীকালে স্যার) জন ফিগিসের জমা দেওয়া রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইহোকু সেনা হাসপাতালে নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। বিমান দুর্ঘটনার জেরে শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গিয়ে নেতাজির শেষ পর্যন্ত হার্ট ফেল হয়েছিল বলেই জানিয়েছিলেন তিনি। তবে স্বাধীনতার পর নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে ভারত সরকার সর্বোমোট তিনটি কমিশন গঠন করেছে।

আরও পড়ুন- ভারতীয় নাগরিক কারা? কীভাবে তা স্থির করা হয়?

১৯৫৬ সালে প্রথম গঠিত হয় শাহনওয়াজ কমিটি। নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি-র প্রাক্তন লেফটেনান্ট কর্নেল তথা তৎকালীন সাংসদ শাহনওয়াজ খান ছিলেন এই কমিটির নেতৃত্বে। এই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছিল নেতাজির।

কিন্তু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বেঁচে আছেন, এমন গুজবের জেরে ১৯৭০ সালে পঞ্জাব হাইকোর্টের অবস্রপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জি.ডি. খোসলার নেতৃত্বে ফের কমিশন গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই কমিশনও ফিগিস ও শাহনওয়াজ কমিটির রিপোর্টের মূল বক্তব্য অর্থাৎ বিমান দুর্ঘটনাতেই যে নেতাজির মৃত্যু ঘটেছিল, সে বিষয়ে সহমত প্রকাশ করে।

দু'টি কমিশন রিপোর্ট দেওয়ার পরও ১৯৯৯ সালে এ বিষয়ে ফের কমিশন গঠন করে ভারত সরকার। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজ কুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় এই কমিশন। তিন দফায় এই কমিশনের মেয়াদ বাড়ার পর ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর রিপোর্ট জমা দেয় মুখোপাধ্যায় কমিশন। এই রিপোর্টে বলা হয়, নেতাজি যে বিমান দুর্ঘটনাতেই নিহত হয়েছিলেন, এ বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ নেই। এই রিপোর্ট ২০০৬ সালের ১৭ মে সংসদে পেশ করা হয়, কিন্তু তৎকালীন সরকার তা খারিজ করে দেয়।

আরও পড়ুন- কেন মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮, ছেলেদের ২১?

এমতাবস্থায় বসু পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকার নেতাজি সংক্রান্ত যাবতীয় নথি (ফাইল) প্রকাশ (ডিক্লাসিফাই) করুক। ২০১৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নেতাজি সম্পর্কিত ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করে এবং তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রের মোদী সরকারও নেতাজি সংক্রান্ত 'গোপন ফাইল' প্রকাশ করা শুরু করে। প্রথম দফায় ১০০টি ফাইল প্রকাশ্যে আনে কেন্দ্র। এরপর ওই একই বছরে আরও ১০০টি ফাইল প্রকাশ্যে আনে মোদী সরকার। কিন্তু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস যে ১৯৪৫ সালের পরও জীবিত ছিলেন, সে বিষয়ে কোনও জোরালো প্রমাণ সামনে আনতে পারেনি প্রকাশ হওয়া কোনও ফাইলই।

২০১৬ সালে প্রকাশ (ডিক্লাসিফাই) হওয়া জাপান সরকারের ১৯৫৬ সালের একটি রিপোর্টও বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু সংক্রান্ত ফিগিসের রিপোর্ট, শাহনওয়াজ কমিটির রিপোর্ট এবং খোসলা কমিশনের রিপোর্টের প্রতিই সহমত জানায়।

আরও পড়ুন- মোদীর এক দেশ, এক ভোট: এর অর্থ কী?

তবে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটির নাম জড়িয়ে গিয়েছে নেতাজি সম্পর্কিত তৃতীয় তত্ত্বটির সঙ্গে। সমাজের একাংশে হঠাৎ প্রবল বিশ্বাস জন্মায় যে স্বাধীন ভারতের উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে গুমনামি বাবা বা ভগবানজি বা মহাকাল নামে ছদ্দবেশ ধারণ করে বেঁচে রয়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। এই রহস্যজনক সাধুর মৃত্যু হয় ১৯৮৫ সালে।

গুমনামি বাবা সম্পর্কিত জনমানসের একাংশে নানা রহস্যজনক বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে এই সাধুর পরিচয় জানতে একটি কমিটি তৈরির নির্দেশ দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট। এরপর ২০১৬ সালে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠিত হয়। বিচারপতি বিষ্ণু সহায়ের এই কমিশন ২০১৯ সালে রিপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু, একাকী জীবন যাপন করা ওই সাধু নেতাজি কি না, সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি এই রিপোর্ট।

আরও পড়ুন- পাক সেনাপ্রধান বাজওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধি কী ইঙ্গিত করে?

এদিকে, ১৫ বছর গবেষণার পর দুই নেতাজি গবেষক অনুজ ধর এবং চন্দ্রচূড় ঘোষ 'Conundrum: Subhas Bose's life after death' নামে একটি বই প্রকাশ করেন। দেড় দশকের গবেষণালব্ধ এই বইয়ে তাঁরা দাবি করেন, বিমান দুর্ঘটনার পর স্বাধীন ভারতে নেতাজি জীবিত অবস্থায় ছিলেন এবং তাঁরা নেতাজি অন্তর্ধান সম্পর্কিত তৃতীয় তত্ত্বটিকে সমর্থন জানান। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটি এই বইটির উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে বলে বিতর্ক দানা বাঁধলেও, স্বয়ং সৃজিত প্রকাশ্যে সে কথা মানতে চাননি।

নেতাজি অন্তর্ধান সম্পর্কিত এই তৃতীত তত্ত্বটিকে সমর্থনের জন্য অনুজ ধর-চন্দ্রচূড় ঘোষ এবং তাঁদের দিল্লি কেন্দ্রিক সংস্থা 'মিশন নেতাজি'র সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বসু পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের অভিযোগ, নেতাজি সম্পর্কে জনমানসে তাঁরা ভ্রান্ত ধরণা তৈরি করছেন। তবে বসু পরিবার এমন অভিযোগ করলেও, অনুজ ধর এবং চন্দ্রচূড় ঘোষ এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং এই দুই গবেষকের দাবি, বসু পরিবারের সদস্যরা নেতাজির সঙ্গে গুমনামি বাবার যোগ সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তাঁদের আরও দাবি, নেতাজি সম্পর্কে এই তত্ত্ব (তৃতীয় তথা গুমনামি তত্ত্ব) যাতে সমাজের মূল স্রোতে না আসে সে জন্য পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

Read the full story in English

netaji srijit mukherjee Srijit Mukherji
Advertisment