তেলের বাজার এমন অবস্থা যে-- পা পিছলে আলুর দম। এর জন্য দায়ী ওমিক্রন। হুহু করে উঠছিল বাজার, আন্তর্জাতিক বাজারে গড়গড়িয়ে চাহিদা বাড়ছিল ক্রুড অয়েলের। ওপেক প্লাস দেশগুলির উপর তেল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মার্কিন চাপও হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। ওপেক মানে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ১৪টি দেশ, এবং নন-ওপেক মানে, রাশিয়া সহ ১৩টি দেশ, এক সঙ্গে ওপেক প্লাস, যাদের উপর আন্তর্জাতিক তেলের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে অনেকটাই। চাহিদার বৃদ্ধি এবং মার্কিন চাপে তাদের সিদ্ধান্ত, দৈনিক চার লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদন বাড়ানোর। কিন্তু ওমিক্রনে সব অঙ্ক ভন্ডুল। তেলের দাম এখন আবার উল্টো দিকে, মানে হুহু করে নেমে যাচ্ছে। ফলে ওপেক প্লাস-কে এই 'মাইনাস' নিয়ে বৈঠক করতে হল। কিন্তু অপরিশোধিতের এই মূল্য হ্রাসে ভারতের বাজারে কী প্রভাব? তেলের তানকারি কি একটু কমবে এখানে? নাকি লাভের গুড় কোম্পানিগুলি খেয়ে যাবে? দ্রুতপতন ও তার প্রভাবের দিকে নজর দিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
ক্রুড অয়েল কতটা পড়ল?
ওমিক্রনের ধাক্কায় মহামারি শুরুর পর সবচেয়ে বড় মাসিক পতন ঘটেছে ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েলের। ব্যারেল পিছু ৮৪.৪ ডলার থেকে এই নভেম্বরের শেষে নেমে এসেছে ৭০.৬ ডলারে। তার পর এ মাসে নামে আরও নেমেছে। বাজার চলতি ভ্যাকসিনগুলি ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকরী কিনা, সেই সংশয়ই এই পতনের পিছনে। ওপেক প্লাস বৃহস্পতিবার এই নিয়ে অনেক মাথা চুলকে স্থির করেছে, তেল উৎপাদন বৃদ্ধির রাস্তা থেকে তারা সরবে না। এতে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ, ওমিক্রনে তো আবার তেলের চাহিদা কমতে শুরু করে দিয়েছে, তা হলে এই বীরত্ব দেখানো কেন! যদিও ওপেক প্লাসের বক্তব্য, তারা নজর রেখেছে তেলের দিকে, পরিস্থিতি সঙ্গীন হলে, বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নতুন করে বিবেচনা করা হবে। উল্টে দিয়ে পাল্টানোর চেষ্টা করা হবে। ওপেকের এ হেন অবস্থানে অপরিশোধিত তেলের দাম সামান্য বেড়েছেও, অন্তত শুক্রবারের বাজার তা-ই বলছে।
অপরিশোধিত তেলের সঙ্কট-কথা
কোভিড কালে লকডাউনের বাজারে তেলের চাহিদা হুহু করে নেমে যায়। দাম চলে এসেছিল তলানিতে। ছুঁয়েছিল এমনকি শূন্য। তার পর অর্থনৈতির চাকায় যখন গতি ফিরে আসতে শুরু করল, হাল হল বিপরীত। চাহিদা বাড়তে থাকল বুলেট গতিতে। তলানিতে থাকা চাহিদা ঝটিকায় ঘুরে দাঁড়ানোয়, শুরু হল ত্রাহি মধুসূদন দশা। তা মোকাবিলা করা কঠিন হল তেল রফতানিকারী দেশগুলির পক্ষে। তেলের উৎপাদন বাড়ানোর চাপ বাড়তে লাগল। দৈনিক ৪ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্তও হল। কিন্তু তাতে আমেরিকা খুশি হয়নি মোটেই। তারা চাইছিল এটা আরও বাড়ুক, আরও। অবস্থা সামলাতে স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ মানে, জরুরি পরিস্থিতির জন্য যে তেল স্টক করে রাখা হয়, তা থেকে তেল ছাড়তে শুরু করে আমেরিকা। চিন, জাপান, ব্রিটেন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতও তাদের রিজার্ভ থেকে তেল ছেড়েছে। (এখন এই ছাড়াছাড়ির মধ্যে যে ওমিক্রন এসে তেলের সব হিসেবে ঠান্ডা জল ফেলে দেবে কে জানত!) এখানে বলে নেওয়া যেতে পারে, ২০২০ অক্টোবরে তেলের দাম ছিল ব্যারেল পিছু ৪৩ ডলার, ঠিক একটি বছর পর তা পৌঁছয় ব্যারেল পিছু ৮৫.৫ ডলারে। স্পষ্টই যে, তেলের দাম কমার দরকার ছিল। কিন্তু এই ভাবে হুড়মুড়িয়ে ওমিক্রনের ধাক্কায় এমনটা মোটেই কাম্য ছিল না কিছুতেই।
ভারতের বাজারে তেলের দামে কী প্রভাব?
এর প্রভাব ভারতের বাজারেও রীতিমতো পড়া উচিত। একশো বার উচিত। কিন্তু মহামারির পর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ফুটো-কড়ি হয়ে গিয়েছিল, তার কোনও প্রভাব কিন্তু এ দেশের তেলের বাজারে পড়েনি। ওয়েল মার্কেটিং কোম্পানিগুলি দাম কমানোর পথে হাঁটেইনি। কোম্পানিগুলি ২০২০ সালের মার্চ থেকে ৮৩ দিন পর্যন্ত পেট্রোল-ডিজেলের দাম অপরিবর্তিত রেখে দিয়েছিল।
নভেম্বরের শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকার লিটার পিছু ডিজেলে শুল্ক কমায় ১০টাকা এবং পেট্রোলে কমায় ৫ টাকা। বিভিন্ন রাজ্যও ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স কমায়। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের এই শুল্ক কোভিড পূর্ববর্তী অবস্থায় যায়নি এখনও। কারণ, ২০২০ সালে তারা পেট্রোলে লিটার পিছু ১৩ টাকা এবং ডিজেলে লিটার পিছু ১৬ টাকা শুল্ক বসিয়েছিল।
আরও পড়ুন ওমিক্রনে তৃতীয় তরঙ্গের ভয় কি আছে, ভ্যাকসিন কি রুখবে ভাইরাস, কী উত্তর কেন্দ্রের?
এর ফলেই এই কাটছাঁটের অভিযানের পরও ২০২১-এর আগের দামে পৌঁছয়নি জ্বালানি। পেট্রোল মুম্বইয়ে বিক্রি হচ্ছে লিটার পিছু ১১০ টাকায়, বছর ২০২১ শুরুর আগের দামের চেয়ে যা ২১. ৭০ শতাংশ বেশি। ডিজেলের দাম সেখানে প্রতি লিটারে ৯৪.১ টাকা। ঠিক এক বছর আগের দামের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি। অনেকেই মনে করছেন, এই যে ওমিক্রনের ধাক্কায় অপরিশোধিত তেলের দাম ঝপ করে কমল আন্তর্জাতিক বাজারে, এটা এ দেশের তেল কম্পানিগুলির উল্লসিত হওয়ার বড় কারণ, সাধারণ মানুষের তাতে কাঁচাকলা। আর যদি তেলের দাম সত্যিই কমে, তা হলে আন্তর্জাতিক বাজারকে নয়, ভোট-দেবতাকে প্রণাম করতে হবে। উত্তর প্রদেশ সহ একাধিক রাজ্যের ভোট যে দোরগোড়ায়। এবং অগ্নিমূল্য বাজার ভোটের বাজারে কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে হিমালয়-সমান একটা ইস্যু বটে!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন