বিজেপিকে এ রাজ্যের বিধানসভায় হারিয়ে দিয়ে তৃণমূলের বিজয়রথের চাকা যেন গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলছে। উপনির্বাচনগুলি থেকে সেই উপলব্ধি হয়েছে পুরোপুরি। তৃণমূলের ঝুলিতে শুধু উপচানো জয় আসেনি, নিজেদের জেতা আসনও বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি। এবং তাদের পক্ষে এটা খুবই দুঃখের ঘটনা, একশো বার। চার কেন্দ্রে তৃণমূলের ফল নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসে বিশ্লেষকদের একাংশ অবাক হচ্ছেন যেমন, তেমনই একাংশের বক্তব্য, রাজ্যের ভোটে বিজেপির রথ আটকে তৃণমূল চোখে ঝিলমিল লাগিয়ে দিয়েছে, তাতে করে এই সব উপভোটে মানুষের মনে হয়েছে, বিজেপি জিততে পারবে না, ফলে তাদের ভোট দিয়ে কী আর লাভ! বিজেপি নিজেদের ভোটেরও বড় অংশ পায়নি পাবলিকের এমন মনস্তত্ত্বে। এবং যা স্বাভাবিকই ছিল, বলছে বিশ্লেষকদের ওই অংশটি। আসুন এই উপনির্বাচনের ফলাফলে আতসকাচ ধরা যাক।
আরও শক্তি বেড়েছে তৃণমূলের
বিধানসভায় বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়াকে রোধ করে দিয়ে তৃণমূল 'জাতীয়' স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এখন। যা মোটেই খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, এ রাজ্যে প্রচারে মোদী-শাহরা মুখ ছিলেন, এখানে বিজেপিকে হারানো মানে মোদি-শাহদেরই হারানো। এখন জাতীয় পরিসরে মাঠটা অনেক বড়, কিন্তু প্রতিপক্ষের নাম যে একই। সেই সমীকরণ থেকে তৃণমূল এই লড়াইয়ে নেমে পড়েছে কোমর বেঁধে। তাদের প্রচার-- নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র রয়েছে। দেশের নেতা কেমন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন। মমতাই মোদীর বিরুদ্ধে আগামী লোকসভায় প্রধান মুখ, এটাই তৃণমূলের মোদ্দা কথা। ফলে বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে যেখানে বিজেপি ক্ষমতায়, সেখানে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া এখন তৃণমূলের পক্ষে অতি জরুরি একটি লক্ষ্য। ত্রিপুরা, গোয়া, অসম, এবং উত্তরপ্রদেশের ভোটে তাই ঘাসফুলের নজর পড়েছে। বিশেষ করে ত্রিপুরা, গোয়ার মতো ছোট রাজ্যের দিকে তাদের পাখির চোখ। আয়তনের ছোটত্বের কারণেই এখানে নিজেদের স্বর সৃষ্টি তুলনায় অনেক সহজ, মনে করছেন তৃণমূলের ম্যানেজারদের অনেকেই।
কিন্তু তৃণমূল যখন জাতীয় লক্ষ্যে ছুটছে, তখনও তাদের মূলচ্যুত যে হয়নি, তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে উপনির্বাচনের ফলাফল। অনেকেরই মত, বেসক্যাম্প নড়বড় হয়ে গেলে গোটা মিশনটার সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে, এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত কিশোররা পুরো মাত্রায় বোঝেন। না বোঝার কারণও নেই। কিন্তু অনেক সময় হয় যে, জয়ের উগ্র গন্ধে গাছাড়া ভাব আসে, পেঁচাপেঁচি বলেও আউট হয়ে যেতে হয়। এটা যারা করে না, তারাই জয় ধরে রাখতে পারে। তৃণমূলও দু'চোখ তাই খুলে রেখেই এগোচ্ছে।
অক্টোবরের ৩ তারিখ তৃণমূল উপনির্বাচনের তিনটি আসন জিতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভবানীপুরে মমতার রেকর্ড জয়। তৃণমূল এই ভাবে বিধানসভায় নিজেদের আসনসংখ্যাই বাড়ায়নি, তাদের ভোটের হারও বেড়ে গিয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে বিধানসভা ভোটে তৃণমূল পেয়েছিল মোট ভোটের ৪৮ শতাংশ। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় একটুর জন্য কানের পাশ দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল তখন। জিতে গেলেন শুভেন্দু অধিকারী। ৩০ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনে মমতা কিন্তু বিপুল ভোট পেয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। তাঁর ঝুলিতে এল ৭১. ৯ শতাংশ ভোট। সামশেরগঞ্জ এবং জঙ্গিপুরে মোট ভোট পেল তৃণমূল ৬০. ২ শতাংশ। ৩০ সেপ্টেম্বর ভবানীপুরের সঙ্গেই এই দুই আসনে ভোট হয়েছিল।
মঙ্গলবারের ফলে তৃণমূল চারটির মধ্যে চারটিতেই যেমন পেয়েছ, তেমনই পেয়েছে মোট ভোটের ৭৫ শতাংশ। এর ফলে বিধানসভায় তাদের শক্তি বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে ২৭১-এ। তৃণমূলের উদয়ন গুহ দিনহাটা থেকে জিতেছেন, ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৮৯ ভোটের মার্জিনে। যা একটি রেকর্ড। উপনির্বাচনে সম্ভবত সর্বকালের সেরা মার্জিন। ছ'মাস আগে বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক এই কেন্দ্রে জিতেছিলেন, যদিও ব্যবধান ছিল মাত্র ৫৭ ভোট। নিশীথ সেই জয়ের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছেন, বিধায়কপদ ছেড়েছেন। সব ওলোটপালটও হয়ে গিয়েছে। গোসাবায় তৃণমূলের সুব্রত মণ্ডলও কম যাননি। জিতেছেন ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৫১ ভোটে। খড়দহে মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় জিতেছেন ৯৩ হাজার ৮৩২ ভোটে। শান্তিপুরে ব্রজকিশোর গোস্বামীর জয়ের মার্জিন ৬৪,৬৭৫।
বিজেপি পিছলে যাচ্ছে বাংলায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হয়েছিল বিজেপি। বিধানসভা ভোটে রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশ ধরেই নিয়েছিলেন এবার আসছে গেরুয়া। ভাল ফল করলেও তাদের পরজয়টাই যেন গোটা ছবিটা পালটে গিয়েছে। বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভোট শেয়ার ছিল ৩৮ শতাংশ। ভবানীপুরে দেখা গেল তাদের ভোট শতাংশ ২২.৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
পাশাপাশি, বিধানসভা ভোটের পর পাঁচ জন বিধায়ক পদ্ম-চ্যুত হয়েছেন পাঁচ মাসে। মুকুল রায়, তন্ময় ঘোষ, বিশ্বজিৎ দাশ, সৌমেন রায় এবং কৃষ্ণ কল্যাণী। সব মিলিয়ে বিধানসভায় বিজেপির শক্তি কমে ৭০। আগে যা ছিল ৭৭। গেরুয়ার পরাজয়ের যে দৌড় শুরু হয়েছে , তাতে অনেকেই বলতে শুরু করে দিয়েছেন, আরও এক দল গেরুয়াধারী বিধায়ক নিজেদের সবুজে চোবাবেন। কে কে সেই তালিকায় রয়েছেন, সেই জল্পনাও চলছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শ্রীরামপুরের একটি সভায় এসে বলেছিলেন, ৪০ জন বিধায়ক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। পরিস্থিতি এখন যা তাতে তৃণমূল শীর্ষ নেতাদের কেউ বিজেপি বিধায়কদের সম্পর্কে এমন কথা বললে ভুল হবে না, রাজনৈতিক মহলের একাংশে শোনা যাচ্ছে এমন কটাক্ষ। যদিও বিজেপি পিছু হটতে রাজি নয়। তাই নিশীথ প্রামাণিক কোচবিহারের জেলা বিজেপির দফতরে ভাইফোঁটা নিতে বলেছেন, ক্লাস টেস্টে কোনও ছাত্র ফেল করার পর, ভার্চুয়াল পরীক্ষায় মানে অনলাইন পরীক্ষায় যদি সেই ছাত্রই স্টার পায় বা ফার্স্ট ডিভিশন পায়, তা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। বড় বড় কথা বলারও কিছু নেই।
আরও পড়ুন কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়া সফর?
কংগ্রেস উধাও, বামেরা এখনও ছবিতে
শান্তিপুরে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১.৪১ শতাংশ ভোট। নোটাই (NOTA) তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলা চলে। নোটা এখানে পেয়েছে প্রায় এক শতাংশ ভোট (০.৯২%)। চারটি আসনের বিচারে নির্বাচন কমিশনের ডেটা বলছে, নোটার চেয়েও কংগ্রের হাল খারাপ। নোটা পেয়েছে ১. ০৭ শতাংশ ভোট, আর কংগ্রেসের ঝুলিতে ০.৩৭ শতাংশ ভোট। বামফ্রন্টের ভোট এই চার কেন্দ্রের উপ-ভোটে ৮.৫ শতাংশ। যা বিধানসভা ভোটে ছিল ৪.৭ শতাংশ। মুখ থুবড়ে পড়া বাম-বিজেপি কোনও দিন উঠে দাঁড়াতে পারবে কি না, সেই আলোচনার কোনও সীমা নেই, আগামীতে তাদের লড়াই করতে হবে অনেক। কিন্তু বিজেপি? সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা 'বিজেপির বঙ্গজয়'-এর কাহিনিটা লিখতে পারবেন নাকি, সেই প্রশ্ন তুলছেন গেরুয়া ব্রিগেডের অনেকেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন