আগামী বছরের শুরুতে উত্তরাখণ্ডে ভোট। কিন্তু সে রাজ্যের রাজনীতি এখন এক জটিল আবর্তে। চার মাসে মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে বদলের ঝড় উঠেছে। মার্চে ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতকে সরিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব মুখ্যমন্ত্রী করেন তিরথ সিং রাওয়াতকে। বিধায়কদের মধ্যে ত্রিবেন্দ্রর বিরুদ্ধে যে ভাবে ক্ষোভ বাড়ছিল, তাতে দিল্লির নেতারা কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। তিরথ সিংকে কিন্তু চার মাসে ইস্তফা দিতে হল। ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি নিয়ে বিজেপি বেআব্রু-- বলতে ছাড়ছেন না কংগ্রেস নেতারা। অনেকে বলছেন, খেলা আরও বাকি আছে।
নতুন মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি। লড়াইয়ে আরও অনেকেই ছিলেন। যেমন সতপাল মহারাজ, রেখা খাণ্ডুরী, ধন সিং রাওয়াত, বংশীধর ভগত, মহেশ যোগী…। ফলে পুষ্করের পথে যে কাঁটা থাকবে না, তা বলা যায় না। আবার পুষ্করকে সামনে রেখে নির্বাচনে বিজেপি লড়লেও, ত্রিবেন্দ্র কিংবা তিরথের কাজকর্ম গেরুয়া ব্রিগেডের বিরুদ্ধে হড়পা বান হয়ে উঠবে না, তাও বলা যাচ্ছে না। তিরথ এই চার মাসে ত্রিবেন্দ্রের একের পর সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছেন, হয়তো তা-ই চাইছিল কেন্দ্রও, কিন্তু বারবার বিতর্কও তৈরি করেছেন তিনি। চার মাসে যে ছক্কা-চার মেরেছেন তিরথ, সে দিকে তাকানো যাক।
গ্যারসেন খারিজ
উত্তরাখণ্ডের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী গ্যারসেনকে তৃতীয় প্রশাসনিক বিভাগ হিসাবে ঘোষণা করেছিল ত্রিবেন্দ্র সরকার, কিন্তু তিরথ কুরসিতে বসেই তা খারিজ করে দিলেন। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, কুমায়ুনের মানুষ এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। এবং কেন্দ্রের কাছে ত্রিবেন্দ্রের পদত্যাগ চাওয়ার কারণগুলির মধ্যে এটি একটি।
চার ধাম দেবস্থানম বোর্ড গঠন
গত বছরের জানুয়ারিতে চার ধাম দেবস্থানম প্রবন্ধন বোর্ড তৈরি করেন ত্রিবেন্দ্র। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও বিভিন্ন মন্দির প্রশাসনকে এই বোর্ডের আওতায় আনা হয়। কিন্তু সন্ন্যাসী-পাণ্ডাদের বড় অংশ, সর্বোপরি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বক্তব্য: এই ভাবে ত্রিবেন্দ্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চেয়েছেন। বোর্ড তুলে দেওয়ার দাবি জানান তারা। বোর্ড গঠনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে বলে জানান তিরথ। ১০ এপ্রিল হরিদ্বারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি বৈঠকের পর এই ঘোষণা তাঁর।
মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ
১২ সদস্যের মন্ত্রিসভায় দুটি পদ ত্রিবেন্দ্রর টার্ম শুরুর সময় থেকেই খালি ছিল। ২০১৯-এ অর্থমন্ত্রী প্রকাশ পন্থের মৃত্যুর পর ওই পদটিও খালি হয়। বিধায়কদের তরফে বার বার দাবি জানানো সত্ত্বেও পদ-পূরণে কান দেননি ত্রিবেন্দ্র। নিজের হাতে ৫০টির বেশি দফতর রেখে দিয়েছিলেন। তিরথ কুরসিতে বসার দু'দিন পরেই মন্ত্রিসভার শূন্যস্থান ভরে দেন।
মহামারি আইনে মামলা প্রত্যাহার
ত্রিবেন্দ্র জমানায় মহামারি আইন না মানার অভিযোগে মামলা হয়েছিল ৪ হাজার ৫০০ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিজেপি কর্মী, ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা, এমনকী কংগ্রেসের বেশ কয়েকজনও। প্রথম বৈঠকেই তীর্থ মামলাগুলি প্রত্যাহার করে নেন।
সরকারের বর্ষপূর্তি উদযাপন বাতিল
ত্রিবেন্দ্র তাঁর সরকারের চার বছর পূর্তি উদযাপনের উদ্যোগ নেন। ১৮ মার্চ ছিল সেই দিন। উত্তরাখণ্ডের ৭০টি বিধানসভায় 'কথা কম, কাজ বেশি' এই থিমে অনুষ্ঠান করার কথা বলেন। ত্রিবেন্দ্রর নিজের কেন্দ্র দইওয়ালায় মূল অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। প্রধান অতিথি হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়করিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাতে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর চেয়াবে বসেই সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন তিরথ সিং রাওয়াত।
নিয়োগ বাতিল
চেয়ারপার্সন, ভাইস-চেয়ারপার্সন, সাধারণ সদস্য, উপদেষ্টার পদে প্রচুর নিয়োগ করেছিলেন ত্রিবেন্দ্র। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এক নির্দেশে সেই সব নিয়োগ বাতিল করেন তিরথ। পদগুলিতে নতুন নিয়োগও করেননি।
চার ধাম যাত্রা
চার ধাম যাত্রায় হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেওয়ার পর, ওই যাত্রা আদালতের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত স্থগিত করে দেয় ত্রিবেন্দ্র মন্ত্রিসভা। তিরথ ক্ষমতায় আসার পর দু'দফায় চার ধাম যাত্রার ঘোষণা করে দেন।
আরও পড়ুন দুই সাংসদের পৃথক রাজ্য দাবি, জেনেবুঝেই কি বাংলাভাগের উস্কানি বিজেপির?
চার মাসে তিরথ বেশ কয়েকটি ঝড়-তোলা বিন্তব্যও করে ফেলেছেন।
'রাম, কৃষ্ণের মতোই মোদী'
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার চার দিন পর তীর্থ হরিদ্বারে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, '… আমি মাঝে মাঝে বলে থাকি, যেমন রাম ও কৃষ্ণ দ্বাপর ও ত্রেতা যুগে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, আধুনিক সময়ে মোদীর গুরুত্বও তেমন…'
হাঁটু-ছেঁড়া জিনস
রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের একটি ওয়ার্কশপে রাওয়াত প্লেনযাত্রায় এক সহযাত্রী মহিলার হাঁটু-ছেঁড়া জিনস নিয়ে তীব্র মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ান। 'যখন ওঁর দিকে তাকালাম, দেখলাম গামবুট পড়ে আছেন, উপরে চোখ ওঠাতে দেখি জিনসের হাঁটু ছেঁড়া, দুটো বাচ্চা ওঁর সঙ্গে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'বোন কোথায় যাচ্ছেন… দিল্লি যাচ্ছেন তো স্বামী কোথায়?… স্বামী জেএনইউ-র প্রফেসর, আপনি কী করেন… এনজিও চালান… এনজি চালান আর আপনার হাঁটুর জিনস ফাটা, সমাজে চলাচল করেন, বাচ্চাও সঙ্গে আছে, কী শিক্ষা দেবেন? ' বিতর্কের ঝড় ওঠায় রাওয়াত অবশ্য ক্ষমা চান।
রেশন বিতর্ক
২১ মার্চ, নৈনিতালে রাওয়াত বলেন, '… যাঁদের পরিবারের সদস্য দু'জন, তাঁরা ১০ কেজি পেয়েছেন, ২০ জন্য সদস্য হলে এক কুইন্টাল পেয়েছেন। এই বেশি পাওয়ার মধ্যে দোষ কীসের? হিংসা করছেন কেন? যখন সময় ছিল তখন কেন আপনি দু'জনের জন্ম দিয়েছিলেন, ২০ জনের জন্ম দেননি?'
'ভারতে আমেরিকার ২০০ বছরের রাজত্ব'
কোভিডে আমেরিকার থেকে মোদীর নেতৃত্বে ভাল কাজ করছে ভারত, এই কথা বলতে গিয়ে রাওয়াত নয়া ইতিহাস রচনা করেন, ' আমেরিকা আমাদের ২০০ বছর ধরে গোলাম করে রেখেছিল, তার সূর্য কোনও দিন অস্ত যেত না।'
করোনা-গঙ্গা
তিরর্ তুলনা টানের দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে তবলিঘি জামাতের সঙ্গে কুম্ভ মেলার, 'কুম্ভের সঙ্গে মারকাজের তুলনা করা যায় না। মারকাজের সভা হলে হয়েছিল, কুম্ভ খোলা জায়গায় হয়, মা গঙ্গার অবিরল ধারা, তার আশীর্বাদ নিয়ে গেলে করোনা হবে না।' কুম্ভে যাওয়া সাধুসন্নাসীদের মধ্যে করোনা কী হারে ছড়িয়ে ছিল, তা এখন সকলেই জানেন।
মোটামুটি আট মাস পরে উত্তরাখণ্ডে ভোট। তিরথ সাংসদ, বিধায়ক নন। ৬ মাসের মধ্যে তাঁকে কোনও বিধানসভা থেকে জিততে হত, আইন এমনই। বিধানসভা নির্বাচনের এক বছরের মধ্যে উপনির্বাচন করা না। আবার কোভিড পরিস্থিতিতে সব উপ-নির্বাচন স্থগিতও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। ফলে তিরথের পক্ষে ভোটে লড়াই করা এখন সম্ভব ছিল না। কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়েছে রাজনীতি। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, তিরথ সিংকে মুখ করে ভোটে লড়লে হারার ভয়টাই আসলে বিজেপিকে তাড়া করছিল, তাই নতুন মুখ্যমন্ত্রী পেল উত্তরাখণ্ড।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন