জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। দিল্লিতে আফগানিস্তান বিষয়ক নিরাপত্তা আলোচনায় বুধবার গ্রুপ ছবিতে তিনিই কিন্তু উচ্চতায় সবচেয়ে ন্যূন। যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর মতো কূটনীতিক আর কে-বা আছে! ক্ষুরধার বুদ্ধি, প্রতিপত্তিতে তিনি বোধ হয় সবার চেয়ে উপরে উঠবেন, ছাপিয়ে যাবেন বাঘা বাঘাদের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ এই ব্যক্তি একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর ক্ষমতাসম্পন্ন। পাকিস্তান গুলে খেয়েছেন তিনি, বলেন অনেকেই। আফগানিস্তান বিষয়ও তাঁর নাকি অসামান্য দখল। ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান আইসি-৮১৪-কে অপহরণ করে কান্দাহার নিয়ে গিয়েছিল তালিবান, সেখানে শীর্ষ কর্তাদের যে দলটি যায়, তাতে ছিলেন অজিত। আফগানিস্তানে হঠাৎ করে ঝড়ের বেগে যেভাবে তালিবান ক্ষমতা পৌঁছছে। যা হয়েছে পাকিস্তানেরই আঙুল ধরে। তাতে দিল্লি চিন্তিত। সেই চিন্তার নিরসন ঘটাতে নানা দর্শী দোভালের উপর অনেকটা ভরসা করছে ভারত সরকার। দিল্লিতে আফগানিস্তান নিয়ে যে আলোচনা, সেখানে হাজির ছিলেন আরও সাত দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। রাশিয়া, ইরান এবং পাঁচটি মধ্য এশিয়ার দেশ-- কাজাকস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান। পাকিস্তান এবং চিন এই আলোচনায় যোগ দিতে অস্বীকার করে।
আলোচনার উৎপত্তি
২০১৮ সালে যখন আমেরিকা স্থির করল তারা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে, তখনই এই আলোচনার প্রয়োজন বোধ করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি। ইরানে সেই বছরই প্রথম এই বৈঠক হল। তাতে যোগ দিয়েছিল আফগানিস্তান, ইরান, রাশিয়া, চিন এবং ভারত। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় বৈঠক হয় সেই ইরানেই। সাতটি দেশ যোগ দিয়েছিল তাতে। তার মধ্যে আগের বৈঠকে না থাকা নতুন দুইটি হল তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান। পাকিস্তান কোনও বৈঠকেই যোগ দেয়নি। সূত্রের খবর, পাকিস্তানের তরফে বলা হয়েছিল যদি ভারত বৈঠকে থাকে, তা হলে তারা থাকবে না, অতএব তেরঙ্গাকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু তেহরান তা মানেনি। পাকিস্তানও নিজেদের গোঁ ছাড়নি। আর এই বৈঠকের ক্ষেত্রে গত সপ্তাহেই পাকিস্তানের এনএসএ মইদ ইউসুফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এই বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন না। ভারতকে কটাক্ষ করে তিনি এও বলেছিলেন, যারা সব তছনছ করে দেয়, তারা কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। চিন আগের দুটি বৈঠকে হাজির থাকলেও, এটিতে সময়াভাব দেখিয়ে আসতে পারেনি। তারা ভারতকে জানিয়েছে, আফগানিস্তান নিয়ে দ্বিপাক্ষিক কিংবা বহু পাক্ষিক কথাবার্তায় রাস্তা খোলা রয়েছে।
আলোচনার গুরুত্ব
এই বৈঠকের উদ্যোক্তা ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েট বা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিবালয়। যারা পর্দার পিছনে থেকে কাজ করে, এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে সরাসরি রিপোর্ট করে। ২০২০ সালে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও, তা কোভিডের জন্য হয়নি। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, এটাই প্রথম যখন আফগানিস্তান লাগোয়া প্রতিবেশী দেশ সহ মধ্য এশিয়ার সব কটি দেশই অংশ নিল এনএসএ বৈঠকে। ভারতের গুরুত্বটাই এর ফলে আরও এক বার প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে শান্তি ও নিরাপত্তার নিরিখে।
চিন ও পাকিস্তানের অনুপস্থিতি সম্পর্কে
আগের দুটি বৈঠক ভারতের উপস্থিতির কারণ দেখিয়ে গরহাজির থেকেছিল পাকিস্তান। এবারের বৈঠকে তাদের হাজিরার সম্ভবনা ছিলই না, এবং তাই হয়েছে। তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের যে রকম গলায় গলায় সম্পর্ক, তাতে তারা এই বৈঠকের ধারপাশ দিয়ে হাঁটবে না স্বাভাবিক ভাবেই। নয়া দিল্লির সূত্র জানাচ্ছে, বৈঠকে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দেশই মনে করে, আফগানিস্তানে সমস্যার উৎস হল পাকিস্তান। যখন তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই চলছিল আমেরিকার সেনার, তখন তালিবানি নেতারা অনেকেই পালিয়ে এসে পাকিস্তানের আশ্রয় বলাহতবিয়তে ছিলেন, মনে করছে ওই দেশগুলি। তা ছাড়া কথায় ও কাজে অনেক ফারাক হয়েছে পাকিস্তানের, তাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন দিল্লির শীর্ষ কর্তাদের অনেকে।
আফগানিস্তানে এখন খাদ্যের তীব্র সঙ্কট চলছে। শীত জাঁকিয়ে পড়লে তা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টন গম সড়কপথে ভারত আফগানিস্তানে পাঠাতে চাইছে। পাকিস্তানকে সেই মর্মে অনুরোধও জানানো হয়েছে। ভারতের সেই অনুরোধে ঝুলিয়ে রেখেছে পাক সরকার। লজ্জাঘেন্না যদি তাদের থাকে, তা হলে এখনই ভারতের এই অনুরোধে পাকিস্তান সম্মতি দিয়ে দিক, বলছে কূটনীতিক মহল। আর চিন আগের দুটি বৈঠকেই হাজির ছিল। কিন্তু এই বৈঠকে তাদের অনুপস্থিতি এই বার্তা দিচ্ছে যে, তারা ভারতের এ ধরনের কোনও উদ্যোগের সঙ্গে নেই। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সুসম্পর্ক যখন সর্বজন জানে। এবং তালিবানের সঙ্গেও তাদের এক সময়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, ফলে দুয়ে দুয়ে চার করাটা শক্ত কিছু নয়।
তালিবান আমন্ত্রিত নয়
উদ্যোক্তা হিসেবে ভারত তালিবানকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানায়নি। অংশগ্রহণকারী দেশগুলিরও কেউ আফগানিস্তানে তালিবান শাসনে সিলমোহর দেয়নি। তবে রাশিয়া, ইরান সহ সহ কয়েকটি দেশের দূতাবাদ আফগানিস্তানে সক্রিয়। তালিবান ছাড়া অন্য কোনও আফগান নেতাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারত ভারত, বলছেন কেউ কেউ। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই কিংবা প্রাক্তন সিইও আবদুল্লা আবদুল্লার কথা বলছেন তাঁরা। কিন্তু কূটনৈতিক মহলের অনেকেরই মত, এতে পরিস্থিতি জটিল হতে পারত আরও। যা ভারত মোটেই চায়নি ও চায়ও না।
ভারতের পদক্ষেপ
কাবুলের খেলায় পাকিস্তান রয়েছে। চিনেরও প্রছন্ন কোনও ভূমিকা থাকতেও পারে। কাবুল পতনের আগে এবং পরে ভারত এর মধ্যে কোথাও ছিল না। তা ছাড়া তালিবানের মন্ত্রিসভায় আইএসআইয়ের লোকজন এবং হাক্কানি গোষ্ঠীর নেতাদের যেমন ভিড়, তাতে ভারতের কোনও ছায়া এতে নেই বলেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই বৈঠকের মাধ্যমে আফগানিস্তান বিষয়ে ভারতের সুর অনেক পোক্ত হবে। আগামী দিনে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় এই প্রতিবেশী দেশটি সম্পর্কে, উচিত কোনটা, সবটাই ভারত বুঝে নিয়েছে এই বৈঠক থেকে। এমনই মনে করছেন কূটনীতিকদের অনেকেই। কারণ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তালিবানের বাড়বাড়ন্তের উপর ভারতকে লাগাম দিতে হবে, না হলে চলবে না।
বৈঠকের ঘোষণা
দিল্লি ডিক্লারেশন। বৈঠকে অংশ নেওয়া দেশগুলি এক হয়ে জানিয়ে দিয়েছে, 'সন্ত্রাসবাদকে কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। কোনও ভাবেই সন্ত্রাসবাদকে অর্থ বা অন্য কোনও ধরনের সাহায্য করা যাবে না। জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করতে হবে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আফগানিস্তানকে কোনও ভাবেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ ক্ষেত্র হতে দেওয়া যাবে না।' দেশগুলির এই যৌথ ঘোষণা থেকেই তালিবানের বিরুদ্ধে বার্তাটা স্পষ্ট। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও বার্তা রয়েছে এতে। যা ভারতের শক্তি বাড়াচ্ছে। এখন পাকিস্তান কী করে সেই দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। কারণ এই সাফল্য, এই বার্তা তাদের গায়ে জ্বালা ধরাবেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন