১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মার্কিন মুলুকে ভয়াবহ হামলা। নিহতের তালিকায় একশো সতেরো জন ভারতীয়। তাই ৯/১১-র ছায়া এ দেশকে ছুঁয়ে। আবার এ দেশের রাজনীতিতেও এই ঘটনা তীব্র অভিঘাত তৈরি করেছিল। ফলে এক ক্রম পরিবর্তনশীল ছবি সামনে এসেছে। হঠাৎ করে তা দেখলে ৯/১১-র ঘটনা মনে না পড়লেও, ছানবিনেই তার অস্তিত্বটা পুরো মাত্রায় টের পাওয়া যায়। কী ভাবে? রক্তশীতল সেই ঘটনা, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা, ইসলামিক সন্ত্রাসের অতলস্পর্শী ভয়ের ছবিটা ঝটকায় সামনে, ফলে, উল্টো দিকে বিজেপির হিন্দুত্বের তত্ত্ব আরও ডানা-মেলা, বেশি করে আম জনগণের কাছে গ্রহণীয় হয়ে যায় যেন। নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহদের প্রভাব আরও বাড়তে শুরু করে এর ফলে।
সন্ত্রাস বিরোধী বিরোধী বিভিন্ন আইনেও এর ছাপ রয়েছে, যেমন সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইন বা প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট (POTA), গুজরাট সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন বা গুজরাট অরগানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট (GUJCOCA)এবং ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA)আইন, বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন বা আনলফুল অ্যাক্টিভিটি প্রিভেনশন অ্যাক্ট (UAPA)-এর সংশোধন ইত্যাদি। বলা যেতে পারে এক আইনি কঠোরতার পথের খোঁজ শুরু হল এ দেশে, সেই হামলার পর।
পোটা আর পাঁচ-কথা
পোটা। ইউএসএ প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট ২০০১-এর ভারতীয় সংস্করণ যেন। ২০০২-এর মার্চে আইনটি পাশ হয়েছিল এই আইন। কংগ্রেস ও তার সঙ্গীরা বিলটির কঠোরতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। রাজ্যসভায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায়, সেখানে বিলটি পাশ করা সম্ভব ছিল না। সংসদের যৌথ অধিবেশন ডেকে এটি পাশের ব্যবস্থা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। যা একটি বিরল পদক্ষেপ নিশ্চিত করেই। এই আইন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ২০০৪-এ ক্ষমতায় এসে কয়েক মাসের মধ্যেই বাতিল করে দেয়।
এরই মধ্যে, সে সময়ের গুজরাত সরকার, মানে নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী, ২০০৩ সাল, গুজরাট সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনের বিল বিধানসভায় আনলেন মোদী। যাকে কিনা পোটার একটা সংস্করণ বললেন কেউ কেউ, কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম সেটি ফিরিয়ে দেন গুজরাত বিধানসভায়, পরের দুই রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ও ফেরান এই বিল।
২০১৯ সালে, রামনাথ কোবিন্দ, বিজেপির আপনজন, রাষ্ট্রপতি, কিছু পরিবর্তন সহ বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর পড়ল অবশেষে। এখানে মনে করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে যখন বিলটি ফেরানো হল, তখন অমিত শাহ গুজরাতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, যিনি এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অনেকেই বলেন, তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ভোটে হেরে কেমন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। যা হোক, সেই সময়কাল জুড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তুষ্টকরণের অভিযোগ এক দিকে এবং জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের কথা অন্য দিকে, নিজেদের নতুন উচ্চতায় যেন তুলে নিয়ে যায় বিজেপি। মুসলিম মৌলবাদী সন্ত্রাসের প্রতি কংগ্রেসের নরম অবস্থান, তাই কংগ্রেস হটাও, এমনই আবহ তৈরিতে কোমর বাঁধে ওঠে, প্রচারে নামে।
এই প্রসঙ্গে বলি, ২০০৭ সালে, গুজরাট নির্বাচনের সময় কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধি নরেন্দ্র মোদীকে 'মওত কি সওদাগর' বলে তোপ দেগেছিলেন, মোদী পাল্টায় সংসদ ভবন হামলায় দোষী আফজল গুরুর ফাঁসি পিছানো নিয়ে মর্মস্পর্শী আক্রমণ শানান। রাজনৈতিক বাইনারি বা দ্বৈত শনশনিয়ে ওঠে, দুই মহাশক্তি লড়াইয়ে--। মোদী বলেন, 'সোনিয়াবেন, যদি আপনারা আফজলকে ফাঁসি দিতে না পারেন, তা হলে গুজরাটকে দিয়ে দিন, আমরাই ওকে ফাঁসিতে ঝোলাব।'
২০১৪-র নির্বাচনের আগে আফজল গুরুকে দুর্নীতিতে দীর্ণ ইউপিএ সরকার ফাঁসিতে ঝোলায়। কিন্তু তত দিনে বিজেপির জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা সপ্তম সুরে এবং কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় তোলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন। গেরুয়া ঝড়ের পূর্বাভাস এসে গিয়েছে চার দিক থেকে। এর আগে, ২০০৮-এর ২৬ নভেম্বর, মুম্বই হামলা, অতঃপর রাজনৈতিক পতনের আশঙ্কায় ইউএপিএ সংশোধন করে আরও কড়া করে তোলে ইউপিএ সরকার। ২০০৪ -এ বাতিল করে দেওয়া যে পোটা, তা-ই যেন নতুন চেহারায় ফিরে আসে, বলেন অনেকে। এবং গুজরাট অরগানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট বিল ফেরানো নিয়ে সে রাজ্যের হাইকোর্টে সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রবল চেষ্টাও চালায়। এখন ইউপিএ-র তৈরি এই আইন এই সরকারের হাতিয়ার, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ দেওয়া হয়েছে। এই আইন বাতিলের দাবিও আরও জোরদার হচ্ছে।
৯/১১-র পর তুঙ্গে ওঠা ইসলামোফোবিয়া, যার অস্ত্রে তুষ্টিকরণের অভিযোগের বড় বড় ঢেউ, তাতেই যেন গেরুয়া পতাকাওয়ালা তরণী, যে নৌকার আকার মন্দিরের মতো, হ্যাঁ রামমন্দি, তা নিয়ে আন্দোলন। বিজেপির এই কাউন্টার দর্শন, টেক্কাই, কংগ্রেসের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব ছিল না, যা আজ ইতিহাসের অধ্যায়। তবে বাজপেয়ী-আডবাণীর জমানায় যে সীমাবদ্ধতা ছিল, গুজরাট হিংসার ফলে সেই সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। গুজরাটে রক্ত-গঙ্গার পর, বাজপেয়ী রাজধর্ম পালনের কথা বলেছিলেন গুজরাটে গিয়ে, সাংবাদিক বৈঠকে, তাঁর পাশে তখন নরেন্দ্র মোদী, মোদীর হাসিতেই প্রমাণ হচ্ছিল, কী তাচ্ছিল্য! কতটা উপেক্ষা! অভিযোগ অনেকেরই।
আত্মজীবনী 'মাই লাইফ'-এ অবশ্য সোজাসাপ্টা ব্যাট করেছেন আডবাণী। ২০০৮-এর নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বইটি প্রকাশ পায়। আডবাণী লিখেছেন, 'নিরীহ মানুষজনকে হত্যা ক্ষমার অযোগ্য, তাই সন্ত্রাসবাদীদের কোনও ধর্ম নেই। যদিও এই সময় সন্ত্রাসের চেহারাগুলির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক যেটি, তা ইসলামের আশ্রয় চাইছে। ভারতে যে সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তার লক্ষ্য দেশ বিরোধিতা এবং কিন্তু আবেদনে প্যান-ইসলামিক।'
পোটা বাতিল করে দেওয়াটা হল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুণ্ডচ্ছেদ করে দেওয়া, তোষণের রাজনীতিই রয়েছে এর পিছনে, সওয়াল করেছেন এককালের বিজেপির লৌহপুরুষ। পোটার মাধ্যমে দু'ডজনের বেশি সংগঠন, এর মধ্যে রয়েছে সিমি, নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আডবাণী। 'যে ভাবে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির অঙ্কে পোটা-র বিচার করেছে কংগ্রেস… পোটাকে মুসলিম বিরোধিতা হিসেবে প্রচার করেছিল তারা। কিন্তু যখন ২০০৪-এর সেপ্টেম্বরে ইউপিএ সরকার এই আইন প্রত্যাহার করে নিল, তখন আমার কষ্টের শেষ রইল না। এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই অস্ত্রভঙ্গকে তারা তুলে ধরল নিজেদের সাফল্য হিসেবেই।'