রাশিয়ার মুদ্রা রুবল একটি বিতর্কের নয়া বুদ্বুদের জন্ম দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, নানা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত যিনি, যুদ্ধ যে কী খেলা দেখায়, তিনি বুঝছেন হাড়ে হাড়ে, দিন কয়েক আগে তিনি বলেন, এবার থেকে রুবলে তাদের থেকে গ্যাস কিনতে হবে। বিশেষ করে যে সব দেশ তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, তাদের প্রতিই এমন ফতোয়া জারি করেছেন পুতিন। মানে, রাশিয়া থেকে ডলার ও ইউরোতে গ্যাস কেনা যাবে না। রুশ প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণা বা দাবি যাই বলুন কেন, তাতে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে বহু দেশ ও সংস্থা। আর যারা ইতিমধ্যে রাশিয়ার থেকে এ সব আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তারা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। জি-সাতের প্রায় সব দেশই পত্রপাঠ পুতিনের এই দাবি খারিজ করে দেয়। বলা হচ্ছে, চুক্তির সময়তেই কিসে পেমেন্ট নেওয়া হবে, সেটা ঠিক করা থাকে। রাশিয়া এক পাক্ষিক ভাবে এমন ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কোনও মতেই পারে না, এটা অনৈতিক, চুক্তিভঙ্গ।
ইউক্রেন হামলা নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমলোচনায় ঝড় বইছে সারা পৃথিবীতে, এখন রুবল সেই ঝড়ের গতিবেগ আরও বাড়িয়েছে। যদিও এদিন খবর মিলেছে, পুতিন স্যর বোধ হয় একটু ব্যাকফুটে গিয়েছেন। রুশ সরকার পরিচালিত জায়ান্ট গ্য়াস সংস্থা গাজপ্রম, সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের এ সিদ্ধান্ত কী ভাবে প্রয়োগ করা যাবে, তা নিয়ে নীতি তৈরি করতে বলেছিলেন পুতিন বৃহস্পতিবারের মধ্যে। এখনও জানা যাচ্ছে না তার ফলাফল কী হল। এবং শোনা যাচ্ছে, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সঙ্গে পুতিনের ফোনে কথা হয়েছে এ দিন। পুতিন নাকি জার্মান প্রধানকে বলেছেন, ইউরোপীয় সংস্থাগুলি ডলার কিংবা ইউরোতে তাদের থেকে গ্যাস কিনে যেতে পারে। শলৎস পুতিনকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এই রুবলে ক্রয়ের সিদ্ধান্তটি মোটেই মানছেন না। কী ভাবে এটা করতে চাইছে রাশিয়া তা যেন লিখিত ভাবে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়।
ক্রেমলিন কী বলছে?
ক্রেমলিনের বক্তব্য, কারেন্সি সুইচ মানে এক মুদ্রা থেকে অন্য মুদ্রায় চলে যাওয়া, এ ক্ষেত্রে ডলার বা ইউরো থেকে রুবলে যাওয়াটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। কারণ, ব্যাঙ্ক অফ রাশিয়ার ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশই বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে একটু বলে নিতে হবে যে, কোনও দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ, যার বেশির ভাগটাই থাকে ডলারে, জমা করা থাকে পৃথিবীর বড় বড় ব্যাঙ্কে। ডলারেই সিংহ ভাগ লেনদেন হয়। কারণ ডলার সবচেয়ে স্থিতিশীল মুদ্রা। যেমন, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বিরাট অঙ্কের ডলার পৃথিবীর বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কে রয়েছে। এখন সেই সব দেশ বা ব্যাঙ্ক ভারতের অ্যাকাউন্ট যদি ফ্রিজ করে দেয়, তা হলে আমদানির ক্ষেত্রে তাদের থেকে ডলার পাবে না ভারত। রাশিয়া যেমন পাচ্ছে না বলে জানাচ্ছে। আবার সেই দেশের ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লেনদেন হলে ডলার যাবেও না রাশিয়ার কাছে, কারণ রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন তো তারা বন্ধ করেছে। ফলে কোনও দেশ বা সংস্থাকে আগে ডলার ভাঙিয়ে রুবল করে তার পর পেমেন্ট করতে হবে।
আরও পড়ুন Explained: যুদ্ধ নয় শান্তির বাণী, রাশিয়ায় ধাক্কা পদত্যাগের, জানেন কেন?
যদিও সব ব্যাঙ্ক যে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রানজেকশন বন্ধ করেছে তা নয়, রাশিয়া এই কারণটিকে সামনে রেখে নিজেদের রুবলের দাম বাড়াতে চাইছে। রুবল দ্রুত পড়ে যাচ্ছিল ডলারের তুলনায়। তা রোখার জন্য এমন কিছু একটা না করলে চলছিল না। তা ছাড়া, এই সিদ্ধান্ত পাল্টা চাপের প্রেক্ষিতেও পুতিনের মাস্টারস্ট্রোক বলা যেতে পারে।
রাশিয়ার কোথায় সমস্যা হবে?
দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে রাশিয়ার সমস্যা হবে। রাশিয়া যদি এই পথে হাঁটে, হয়তো রুবলে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ কিনবে রুশ গ্যাস। চিনা মুদ্রা থেকে রুবল করেও অনেকে ক্রয়ের কাজটা করতে পারে। কিন্তু অনেকে আবার বিকল্প উপায় খুঁজে নেবে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার অর্থনীতি ধাক্কা খাবে। রাশিয়ার জাতীয় বাজেট অনুযায়ী তেল এবং গ্যাস থেকে তাদের আয় হয় মোটা অঙ্কের। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্য়ে মোট আয়ের যা ৪৩ শতাংশ। যুদ্ধের ফলাফলে এই ভাবে রাশিয়ার মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে। এখানে এটাও বলতে হবে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ নেয় রাশিয়া থেকে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে যা রুশ দেশ থেকে পৌঁছয়। এবং যার মধ্যে ভাল সংখ্যক লাইন পাতা ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে। এখন সহজেই অনুমেয় এই লাইনগুলির হাল ভাল নয়। তু-তু ম্যাঁয় ম্যাঁয় বন্ধ করতে হবে তাই এখনই। মানবিকতায় অঙ্গাঙ্গী বোধ হয় অর্থও। অর্থের স্বার্থে যুদ্ধ বন্ধ না করলে চলবে না।