৮০ বছর আগে। ১৯৪২-এর অগস্ট মাস। স্বাধীনতার জন্য প্রবল তৃষ্ণার্ত এ দেশ। মুক্তির লক্ষ্যে দেশের মানুষ মরিয়া। ব্রিটিশের মসনদ এবার ভাঙবেই, তারা একবগ্গা। ইংরেজের সূর্য তো অস্তাচলে, তার শেষ আলোর কামড়টা যেন-বা বাকি। তখনই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন গান্ধিজি, দেশ তাঁর ডাকে তীব্র সাড়ায় উন্মত্ত হল। এটাই চাইছিল সবাই।
স্বাধীনতার জন্য এই বাঁধ ভাঙা উন্মাদনা তৈরির প্রেক্ষাপটটা কী ছিল?
স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের কথা বলতে হবে এ প্রসঙ্গে, বলতে হবে তাঁর এক ব্যর্থ প্রস্তাব প্রসঙ্গে। যা এই আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল। আসলে সেই সময় ভারত যেমন স্বাধীনতার লক্ষ্যে ফুটছে, তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধুন্ধুমার পরিস্থিতি। ক্রিপস ছিলেন যুদ্ধকালীন যৌথ ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য। বামপন্থী লেবার পার্টির নেতা। ভারতের স্বায়াত্তশাসনের পক্ষেও ছিলেন তিনি। ক্রিপসকে ভারতে পাঠানো হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যাতে ইংরেজের পক্ষেই ভারতবাসী থাকেন, সেই লক্ষ্যে। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতো প্রথম সারির দলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। আলোচনায় তাঁর ঝুলি থেকে এক প্রস্তাব বেরিয়ে এল: ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের সম্পূর্ণ সমর্থন করবে ও তাদের প্রতি অনুগত থাকবে, প্রতিদানে যুদ্ধের পর ভারতকে পূর্ণ স্বায়াত্তশাসন এবং নির্বাচনের অধিকার দেবে ব্রিটিশ সরকার। ক্রিপস এই প্রস্তাব কিন্তু মানাতে পারলেন না। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ তাঁকে নিরাশ করল নিদারুণ। এমনকি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলও এতে সম্মত ছিলেন না। ক্রিপসের মিশন ব্যর্থ হল এর ফলে, কিন্তু ভারতের মানুষ তো এই মিশনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার একটি সুরেলা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিল। তাও তো ভেঙে গেল। ক্ষোভের আগুন বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল তাতেই। কংগ্রেস বুঝতে পারল সেটা হাড়ে হাড়ে। মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা অধিবেশনে কংগ্রেস এ নিয়ে আলোচনায় বসল। নেতাদের বেশির ভাগই স্থির করলেন গান্ধিজির নেতৃত্বে এক বড় আন্দোলনের ডাক না দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
সি গোপালাচারীর মতো বিরোধীও ছিলেন। যা হোক, সিদ্ধান্ত তো সংখ্যাগরিষ্ঠের। ফলে গান্ধিজি এক সভার ডাক দিলেন এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার লক্ষ্যে। মধ্য মুম্বইয়ের তারদেও অঞ্চলের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে সেই সভা হল। সেটা অগস্টের ৮ তারিখ। মহাত্মা গান্ধি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন সেখানে, তখন মধ্য রাত প্রায়। মানুষ উদ্বেলিত হল। ফেটে পড়ল। পর দিন, মানে ৯ অগস্ট, ব্রিটিশের পাল্টা সক্রিয়তা শুরু হয়ে গেল ভোর থেকেই। কংগ্রেসের তাবড় নেতা গ্রেফতার হলেন। গান্ধিজিও হলেন। পুণের আগা খান প্যালেসে মহাত্মা গান্ধি, কস্তুরবা গান্ধিদের বন্দি রাখা হল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন কিন্তু থামল না। মানুষই এর নেতৃত্বে। গান্ধিজি সে কথা বলেও ছিলেন তাঁর ভাষণে। দেশের নাগরিকদের কোন দলের কী করণীয় তাও বলা হয়েছিল তাতে। দেখা গেল, কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে। তার রূপ ভয়ঙ্করও হচ্ছে। অনেকেই বলেন, গান্ধিজির অহিংসবাদী অবস্থান এ আন্দোলনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পথে এ বার আর হাঁটেননি মোহনদাস। তাঁর মত ছিল, ব্রিটিশের বড় হিংসার জেরেই মানুষ এ ভাবে উন্মত্ত। এর দায় ব্রিটিশের। যদিও গান্ধিজির উপর আন্দোলন প্রত্যাহারের লক্ষ্যে কম চাপ দিয়ে চলেনি শাসক ইংরেজ। কম দুঃখেরও নয় গান্ধিজির সেই বন্দি-কাল।
প্রথমে আগা খান প্যালেসে গান্ধিজির সচিব মহাদেব দেশাইয়ের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হল। গ্রেফতারির মাত্র ৬ দিন পর, ৫০ বছর বয়সে। গ্রেফতারির ১৮ মাস পর, মারা যান কস্তুরবা। গান্ধিজিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং ব্রিটিশ সরকারের শীর্ষে এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। ওই প্যালেসে গান্ধিজির সঙ্গে ছিলেন সরোজিনী নায়ডু। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনিও। তাঁকে ১৯৪৩-এর ১৯ মার্চ মুক্তি দেওয়া হল। কিন্তু গান্ধিজিকে ছাড়ার নাম করছে না ব্রিটিশ সরকার। গান্ধিজি দু’বার ২৬ জানুয়ারিতে জাতীয় পতাকা তোলেন সেখানেই। তার আগে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঢেউয়ে দেশে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে স্বাধীন সরকার গঠন করে ফেলেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীর দল। প্রথম জাতীয় সরকারটি গঠিত হয় আমাদের রাজ্যে, মেদিনীপুরে। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।
গান্ধিজি মুক্তি পেলেন তাঁর স্বাস্থ্যের হাল আরও গুরুতর হলে। ১৯৪৪-এর ৬ মে। ইংরেজ আসলে চায়নি বন্দি অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হোক, তাতে নিজেদের ঘরে যেমন শত্রু বাড়বে অনেক, তেমনই ভারতের পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে একেবারে। যদিও ব্রিটিশের চূড়ান্ত দমনপীড়নে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমানো গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। রক্তগঙ্গায় এবং ধরপাকড়ের এক বেনজির ছবি তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা।