নীলার্ণব চক্রবর্তী: রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আজকের নয়। স্বাধীনতার পর, যে সম্পর্ক সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত-- দুইয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যরক্ষায় ভারতকে তৎকালীন সোভিয়েত সর্বাধিনায়ক স্ট্যালিনের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু নব্য স্বাধীন ভারতের বেশি দরকার ছিল প্রবল শক্তিধর ওই কমিউনিস্ট দেশকে। সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ, যিনি ১৯৫২ সালে হলেন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি এ দেশের, এবং তার পর, ১৯৬২-তে রাষ্ট্রপতি হলেন। উপ-রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি রাশিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেই দেশে কৃষ্ণণ ভারতের দ্বিতীয় দূত এবং জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত ছিলেন প্রথম।
বিজয়লক্ষ্মী নম-নম করে রাশিয়ায় কাটিয়েছিলেন, আর, রাধাকৃষ্ণণের কালে দু'-দেশের সম্পর্ক বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছিল। বলা যেতে পারে, রাশিয়া এবং ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রাথমিক সিলমোহর দিয়েছেন এই তামিল ব্রাহ্মণ ও দার্শনিক, যিনি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি কখনও। রাষ্ট্রদূতদের অনেকেরই ছায়া না-মাড়ানো স্টালিন তাঁর সঙ্গে দু'বার সাক্ষাৎ করেন। প্রথম বার সাক্ষাতের পর কৃষ্ণণ সম্পর্কে স্টালিন বলেন, এই ভদ্রলোকটি রক্তাক্ত হৃদয় দিয়ে কথা বলেন, ইনি সাধারণ কোনও রাষ্ট্রদূতের মতো নন।
দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক তার পর অনেক পথ পেরিয়েছে। অনেক চড়াই-উৎরাই দেখা গিয়েছে। কিন্তু এখনকার মতো আশ্চর্য বাঁকে এসে আগে কখনওই বোধ হয় দাঁড়ায়নি। শ্যাম রাখি না কূল, রাশিয়াকে রাখি না আমেরিকাকে-- এই হচ্ছে বর্তমানের হাল। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধাবস্থায় ভারতের বিদেশনীতির তাই মহাসঙ্কটে। তার উপর এসেছে, অনেকটা গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো, ইউক্রেনে থাকা ভারতীয়দের ফেরানোর ইস্যু। যে ভারতীয়দের বেশির ভাগই ছাত্র, যাঁদের মধ্যে একজনের বেঘোরে মৃত্যু হয়েছে রুশ গোলায়, মঙ্গলবার ঘটেছে এই অমঙ্গলের ঘটনা। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর খারকিভে ন্যাশনাল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। কর্নাটকের হাভেরির বাসিন্দা, নাম-- নবীন শেখরাপ্পা। অনেকেই বলছেন, যুদ্ধের সলতে পাকানোর পর্বে ভারত সরকার 'কী করি আমি কী করি' করি করে কাটিয়ে দিয়েছে। এখন অথৈ সাগরে পড়ে গিয়েছে ইউক্রেন থেকে ভারতীয়দের ফেরানোর উদ্যোগ 'অপারেশন গঙ্গা'। এখন 'বলরে সুবল বল দাদা' করে আর কি হবে!
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারসাম্যের নীতিতে হাঁটতে গিয়েই হয়তো দেরিটা হয়েছে। আসলে সরু দড়ির উপর দিয়ে এখন হাঁটতে হচ্ছে দেশের কূটনীতিকে, এ পরীক্ষা কঠিন, এর মধ্যে পড়ুয়া ফেরানোর মন দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু ভারসাম্যের নীতি কেন? ভারতের কী দরকার রয়েছে ভারসাম্যের পথে হাঁটার? হ্যাঁ, দরকার রয়েছে। যে দরকারের তীব্রতা সবিশেষ, দেশরক্ষার প্রশ্নে এই ভারসাম্যের নীতি বেশ ধারাল এবং ভারীও।
আরও পড়ুন Explained: রুশ হামলায় নিহত ভারতীয় পড়ুয়া, বিশ্ব দরবারে কেন চ্যালেঞ্জের মুখে ভারতের কূটনীতি?
ভারসাম্যের নীতির নেপথ্যে আছে রাশিয়ার উপর ভারতের অস্ত্র নির্ভরতা। রাশিয়া থেকেই ভারতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আসে। আগে যা ৭০ শতাংশ ছিল, বর্তমানে ভারত সরকার দেশে অস্ত্র নির্মাণে উদ্যোগী হওয়ায়, এই আমদানি কমে ৪৯ শতাংশ হয়েছে। এই অস্ত্রসম্ভারের মধ্যে যেটি নিয়ে জনে জনে আলোচনা চলছে, সেটি হল এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। সীমান্ত সুরক্ষায় যা ভারতের বড্ড প্রয়োজন। এ দেশের সঙ্গে রাশিয়ার এই মিসাইল কেনায় মাথা-ঘোরানো অর্থিক চুক্তি হয়েছে। ২০১৮-র অক্টোবরে এই চুক্তি হয়। আর্থিক মূল্য তার ৫.৪৩ বিলিয়ন, বা ৪০ হাজার কোটি টাকা।
এখন আমেরিকার একটি আইন রয়েছে, যার নাম-- কাউন্টারিং আমেরিকা'স অ্যাডভার্সারিস থ্রু স্যাংশন, বা সিএএটিএসএ। এই আইনে রাশিয়ার থেকে ভারতের এই মিসাইল কেনায় আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, এই আশঙ্কা বাড়ছে। কারণ ইতিমধ্যেই রাশিয়ার থেকে ওই অস্ত্র তুর্কি কিনেছে বলে সেই ক্রয়ে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা জারি করে ফেলেছে। মনে রাখতে হবে, তুর্কি কিন্তু নেটোভুক্ত দেশ, সে ক্ষেত্রে আমেরিকার বন্ধুও। তুর্কির এই অস্ত্র কেনায় লাল সিগনাল জ্বালিয়ে আমেরিকা বলেছে, এই অস্ত্র-ক্রয়ে মার্কিন মুলুকে সুরক্ষায় আঁচ আসতে পারে, এ সব চলবে না। ভারতে রুশ ওই মিসাইল প্রথম আসার পরেও আমেরিকা বেশ কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল। বলেছিল, তারা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন Explained: রাশিয়ার ক্লাস্টার-ভ্যাকুয়াম বোমায় তছনছ ইউক্রেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা ভয়ঙ্কর এই অস্ত্র?
আমেরিকা ও রাশিয়া-- দুই দিকেতেই রই পরান জলাঞ্জলি দিয়া, এই হচ্ছে ঘোষিত ভারসাম্য। ঘুরিয়ে রাশিয়ার সমালোচনাও করতে হয়েছে সেই ভারসাম্য-প্রয়োজনে। কিন্তু অস্ত্র না হলে এ দেশের সীমান্তে অন্য আর এক যুদ্ধ শুরু না হয়ে যায়, তাই এ ব্যাপারটা অণুমাত্র অবহেলা করা যাবে না এখন। রাশিয়াকে চটানো তাই অসম্ভব। ফলে, ভারসাম্যের নীতিটা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে, সে কারণে ইউক্রেন হামলায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিন্দাপ্রস্তাবে ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেনি।
ভারসাম্য যে বড় বিষম বস্তু! অনেক কসরত করতে হয় সেটি বজায় রাখতে। বুদ্ধির বিদ্যুৎ অবিচ্ছিন্ন রাখতে হয়, মস্তিষ্কের ভারসাম্য যাতে বিচ্যুত না হয়। তা না হলে হুঁশ পরে ফেরে, এবং চলে যায়, আচমকা, নিরীহ কারওর প্রাণ।