আঁধার নেমেছে আফগানিস্তানে। তালিবানের মুঠো শক্তসমর্থ। কাবুল ছাড়ার ঢল। সেই দলে শিখরাও। হাতে-গোনা যে সংখ্যক শিখ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন সে দেশে, তাঁরা অনেক দিন মাটি কামড়ে ছিলেন, কিন্তু আর না। এ বার না ফিরলে যে বুলেট-বেঁধা মৃত্যুই, সুন্দর ভুবনে কে আর মৃত্যুকে শ্যাম সমান মনে করবে? সোমবার ৪৬ জন আফগান শিখ ভারতে ফিরেছেন, সে দেশে থেকে-যাওয়া ছ'টি গ্রন্থসাহিবের তিনটি নিয়ে এসেছেন তাঁরা। একটু অতীতে যেতে হবে এই সূত্রে।
ভারতবর্ষের অংশই ছিল আফগানিস্তান সে কালে, শিখদের সংখ্যা ছিল ভালই। মিলেজুলে শিখ-মুসলিম-হিন্দু বাস করার সে এক দিন ছিল বটে। শিখরা ব্যবসায় পসরা সাজিয়েছিলেন কাবুলের নানা এলাকায়। বহু দোকানের মালিক ছিলেন তাঁরা। তে হি নো দিবসা। সে দিন কবেই যে গিয়েছে! এখন পালানোর পালা। এ বার কী হবে, মূল উৎপাটিত… আকাশ-পাতাল এই সব ভাবতে ভাবতেই নিশ্চয় ফিরেছেন শিখরা। চোখের জল উৎকণ্ঠার তাপে শুকনো। দিল্লির শিরোমণি অকালি দলের সভাপতি পরমজিৎ সিং স্বর্ণ তো এই দেখেই বললেন (টুইট করলেন), আফগানিস্তানে শিখ-যুগে যবনিকা।
আফগান মুলুকে শিখ-ইতিহাসের অ-আ-ক-খ
আফগানিস্তানে শিখদের মূল অনেক গভীরে। এ নিয়ে লেখালিখিও হয়েছে অনেক। ইন্দ্রজিৎ সিংয়ের বই 'আফগান হিন্দুস অ্যান্ড শিখ: হিস্ট্রি অফ থাউস্যান্ড ইয়ার্স'-এ কী বলছে? বলছে যে, খোরাসানে (মধ্যযুগের আফগানিস্তান। সেই সময় প্রায় পুরো আফগানিস্তান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশকে একসঙ্গে খোরাসান বলা হত।) গিয়ে শিখধর্মের বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন শিখ-প্রবক্তা স্বয়ং গুরু নানক। পঞ্চদশ শতাব্দীতে তিনি ওই অঞ্চলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
নানকের জন্ম পাকিস্তানের লাহোরের কাছে তালবন্দি গ্রামে। হিন্দু ধর্মের সংস্কারক হিসেবেই উত্থান। পৃথিবী নয় খণ্ডে বিভক্ত বলে মনে করা হত তখন। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম। নানক প্রতিটিতেই নাকি গিয়েছিলেন। পদব্রজে। তাঁর জীবনটাই একটা এগিয়ে চলা, যাত্রা। মূলত পাঁচ বার তিনি এমন যাত্রা করেছিলেন, ১৫০০ থেকে ১৫২৪ সালের মধ্যে। বলা হয়ে থাকে, নানকই ইবন বতুতার পর, সবচেয়ে বেশি পথ হেঁটেছিলেন। ২৪ হাজার কিলোমিটার তার দৈর্ঘ্য, দাবি এমনই। তিব্বত, দক্ষিণ এশিয়া, আরব… যাত্রা শুরু করেন ১৪৯৬ সালে, ২৭ বছর বয়সে। নানক মক্কা, বাগদাদ, মুলতান ইত্যাদিতে গিয়ে নিজের ধর্মীয় ধারণা নিয়ে ভিন্ন ধর্মীয় মুখিয়াদের সঙ্গে বিতর্ক করতেন। ১৫০৮ সালে বাংলার সিলেট অঞ্চলে নাকি এসেছিলেন তিনি, তার পর নাকি গিয়েছিলেন অযোধ্যায়। তুলনায় কাবুলের দূরত্বটা ঘর থেকে বারান্দায় আসাই, তাই না? ফলে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে শিখধর্ম।
বেশির ভাগ ধর্মের উৎপত্তির পিছনে একটি প্রতিবাদ রয়েছে, আন্দোলনও। খ্রিস্ট ও ইসলামের মতো শিখধর্মেও তেমনটা রয়েছে। নৃতত্ত্ববিদ রজার ব্যালার্ডের ২০১১ সালের গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, 'এই অঞ্চলে নবম এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মুসলিম করার যে গা-জোয়ারি শুরু হয়েছিল, ক্রমে তার প্রতিবাদে এক দল সরব হয়ে উঠলেন, প্রতিরোধ গড়ে তুললেন তাঁরা, গুরু নানকের মতাদর্শের পথে চলত সেই দলটি।' ক্রান্তিকাল বেয়ে বিকাশ পেয়ে গেল নানকের ধর্মমত। নানক অবশ্য হিন্দুধর্মের সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন প্রথমে, সেই সংস্কারের পথ থেকেই নয়া শিখধর্ম পোক্ত হয়ে উঠল পরবর্তী গুরুদের হাতে।
আরও পড়ুন কাবুল এয়ারপোর্টে হামলার দায় স্বীকার, কারা এই ইসলামিক স্টেট-খোরাসান?
এখানে একটা কথা বলে নিতে হবে, মত-প্রচারে নানকের সঙ্গে দীর্ঘ যাত্রার সঙ্গী ছিলেন ভাই মর্দানা নামে এক মুসলিম। গুরু নানক যখন ভগবানের গান গাইতেন, যখন সাধারণকে ধর্মকথা বলতেন, তখন মর্দানা রবাব বাজিয়ে সঙ্গত করতেন। ১৫০৪ সালে মুঘল সম্রাট কাবুল দখল করেন। কাবুলকে 'হিন্দুস্তানের আপন বাজার' হিসেবে বাবর উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। ১৭৩৮-এ কাবুলের সঙ্গে সীমান্ত-বিচ্ছেদ হল এ দেশের, যখন ইরানের রাজা দোর্দণ্ডপ্রতাপ নাদির শাহ দখল করলেন কাবুল। তবে মধ্যবর্তী সময়ে শিখগুরুদের শ্রদ্ধা জানাতে কাবুল থেকে বহু জন আসতেন পূর্ব পঞ্জাবে, পূর্ব পাঞ্জাব থেকেও শিখধর্ম প্রসারে অনেকেই গিয়েছেন কাবুল এবং সংলগ্ন এলাকায়। বলা যেতে পারে বাধাহীন এক যোগাযোগের অবহাওয়া মোটামুটি বজায় ছিল মুঘল যুগে।
সহজ যোগাযোগের উদাহরণ রয়েছে অনেক। স্বরূপদাস ভাল্লার 'মহিমা প্রকাশ' বইয়ে কাবুলি এক মহিলার (কাবুলি মা) কথা বলা হয়েছে, যিনি পূর্ব পঞ্জাবের গোন্দিওয়ালে সিঁড়িওয়ালা কুয়ো তৈরিতে শ্রম দিয়েছিলেন উজাড় করে। আবার, 'ভাই গোন্দা'র কথা রয়েছে, যাঁকে কিনা কাবুলে পাঠানো হয়েছিল সপ্তম শিখ গুরুর উপদেশ প্রচারে, গুরুদ্বার তৈরির মিশনও ছিল তাঁর।
শিখদের আফগানিস্তান ছাড়ার কাহিনি
আফগানিস্তানে শিখদের উপর প্রথম সবচেয়ে বড় ধাক্কা এল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। আবদুল রহমান খান যখন আফগানিস্তানের আমির। নিষ্ঠুর শাসক রহমান খান। ব্রিটিশরা সন্ত্রাসের রাজা বলত তাঁকে। ১ লক্ষ মানুষকে তিনি প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন। তাঁর ভয়ে থরহরি কম্পমান ছিল গোটা আফগানিস্তান। বহু হিন্দু এবং শিখ হত্যা-আতঙ্কে সে সময়ে সে দেশ ছাড়েন। এবং তাঁরা পঞ্জাবের পাতিয়ালায় এসে বসবাস শুরু করেন। পাতিয়ালার আফগান-শিখ সমাজের সূত্রপাতও প্রায় তখনই। এর পর, ১৯৯২। যখন মুজাহিদিনরা আফগানিস্তানের দখল নিল, শিখরা হুড়মুড়িয়ে দেশের মাটি ছাড়তে শুরু করলেন। কেউ ভারতে এলেন, কেউ বা ইউরোপে চলে গেলেন, বা অন্য কোথাও কোনওখানে গেলেন কেউ কেউ।
মুজাহিদিনরা যে তাদের উপর গণসন্ত্রাস নামিয়ে আনবে, সেই আশঙ্কা, বোঝাই যাচ্ছে, এ সব কিছুর মূলে ছিল। কারণ, ১৯৮৮-তে বৈশাখীর প্রথম দিনে, গুরুদ্বারে ঢুকে AK-47 এলোপাথাড়ি চালিয়ে ছিল এক আততায়ী, নিহত হয়েছিলেন ১৩ জন শিখ। পরের বছর জালালাবাদে গুরু তেগ বাহাদুর সিং গুরুদ্বারে মুজাহিদিনরা রকেট হামলা চালায়। তাতে ১৭ জন শিখ মারা যান। ইন্দ্রজিৎ সিংয়ের বই বলছে, ১৯৮৯ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, জালালাবাদে হামলায় শিখরাই ছিল মূল টার্গেট। ছ'মাসে একশো জন শিখ মারা গিয়েছেন জঙ্গিদের হাতে।
আরও পড়ুন লাহোরের বুকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল মহারাজা রঞ্জিৎ সিংয়ের মূর্তি, কেন এত রাগ?
এর পর মুজাহিদিনদের দখলে কাবুল চলে যাওয়া, আফগান মুলুক ছাড়তে লাগল তখন দলে দলে শিখ। অত্যাচার, খুনখারাপিও চলতে থাকল সেই সঙ্গে। বাড়ছিল মুজাহিদিনদেরই একটি শক্তি তালিবান। তারা ক্ষমতা এল ১৯৯৪-এ। অত্যাচার, আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে গেল আরও। শিখরা বুঝে গেলেন, আফগানিস্তানে এ বার তাঁদের দিনাবসানের পালা। ইন্দ্রজিৎ সিং জানাচ্ছেন, '১৯৯০-এর প্রথম দিকে ৬০ হাজারের বেশি হিন্দু ও শিখ বাস করতেন আফগানিস্তানে। তা হু হু করে কমতে কমতে ২০১৯-এ এসে দাঁড়ায় হাজারে। মূলত তাঁদের বসবাসের ক্ষেত্রটা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় কাবুল, জালালাবাদ এবং গজনিতে। সেখানেও শিখদের অনেকের বাড়িতে দখলদার, গৃহবাসীরা আশ্রয় নিয়েছেন গুরুদ্বার, মন্দিরে। এই এলাকার বাইরে সব গুরুদ্বার-মন্দির বেদখল ততদিনে।'
না এখানেই শেষ নয়। ২০১৮ সাল। জালালাবাদে আত্মঘাতী হামলা। অন্তত ১৯ জন নিহত তাতে। গুরু হর রাই সাহিব গুরুদ্বারে, ২০২০-তে, হামলা চালাল জঙ্গিরা, তাতে ২৫ জনের মৃত্যু। যদি আফগান-মুলুক না ছাড়ো, তা হলে জানে মেরে দেব। এই যখন বার্তা, তখন তো মাটির মায়া করলে চলে না। ভারত তাই ভরসাস্থল। 'এক দেহে হল লীন' এ দেশেরই রিংটোন।