ছড়ায় অতি দ্রুত, কিন্তু দাঁতের জোর কম। ঝলকে এটাই ওমিক্রন। কিন্তু ওমিক্রন ধরলে অসুখের তীব্রতা কেন কম হয়ে থাকে, তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে বেশ কিছু। ইঁদুরের উপর যথারীতি ওমিক্রন-তোপ দাগা হয়েছে বার বার, এবং ইঁদুর এই সুসংবাদও বয়ে এনেছে যে, ভাইরাসটির নজর মোটামুটি উপরের দিকে। কী রকম? না, ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে দেখা যাচ্ছে-- নাক, গলা এবং শ্বাসনালীতেই সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। তার নীচে বিশেষ একটা নামছে না। বার্লিন ইনস্টিটিউট অফ হেলথের কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট রোনাল্ড এলিসের কথায়, পরীক্ষা থেকে স্পষ্ট, এই ভাইরাসের কেরামতি, সংক্রমণের নজর শ্বাসযন্ত্রের উপরের তলায়। আগের ভ্যারিয়েন্টগুলির তুলনায় এটাই ওমিক্রন-পার্থক্য। তবে ফুসফুসে নেমে গিয়ে তলোয়ার তুলে নিয়ে যে ঝপাত কোপটি ওমিক্রন দিচ্ছে না সচরাচর, তা ইঁদুররা শুধু নয়, মানবশরীরই জানান দিয়ে চলেছে।
গত বছর নভেম্বরে ওমিক্রনের প্রথম খবর হয়। বিজ্ঞানীরা তার পরই আদাজল খেয়ে ঝাঁপ কাটেন এই ভাইরাসের ভিতর। টেনে-হিঁচড়ে এর সব তথ্য বার করতে থাকেন তাঁরা। জানতে পারেন, ৫০ বার জিনের বদল বা মিউটেশনের ফলে এর উৎপত্তি। দ্রুত সংক্রমণ-ক্ষমতা। নয়া ঢেউয়ের জন্মদাতা এই ভাইরাস অ্যান্টিবডিকে চুক্কি দিয়ে শরীরে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু উপসর্গ মৃদুই হচ্ছে বেশির ভাগের। অন্তত এখনও পর্যন্ত। যদিও ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্র গুপ্ত বলছেন, 'মিউটেশনের ফলে নয়া চেহারায় পৌঁছানো ভাইরাস সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট অনুমান করা একেবারে অনুচিত।' মানে, তিনি বলতে চাইছেন, অনুমান করে আপনি ভাবলেন যে, হনুমান অদ্দুর লাফ দেবে, তার পর দেখলেন তার চেয়ে অনেক বেশি লম্ফ দিয়ে সে একেবারে লঙ্কায় পৌঁছিয়ে গিয়েছে!
বিজ্ঞানী গুপ্তের মতো আরও অনেকে ভাইরাসের দিকে নজর ফেলে বসে রয়েছেন। একটুও এদিক-ওদিক ভাইরাসবাবাজিকে করতে দিতে তাঁরা রাজি নন। আবার ভাইরাসও তাঁদের ঘুমের বড়ি খাইয়ে পালিয়ে যেতে চায় এবং লাগাতার যায়ও। প্রাথমিক স্তরে দেখা গিয়েছিল, কম বয়সিদের মধ্যেই ওমিক্রনের বেশি রবরবা। যাঁরা আগের ভ্যারিয়েন্টগুলিতে তুলনায় কম আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা যেন এর টার্গেট। যদিও এটি তাঁদের বিশেষ একটা কাবু করতে পারেনি এ পর্যন্ত। হতে পারে, কাবু করতে না পারার কারণ হয়তো তাঁদের বেশির ভাগই ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন। কেউ কেউ কোভিড-জয়ীও হতে পারেন। এবং এই তথ্যটা এখনও পুরোপুরি সামনে আসেনি যে, প্রতিষেধক না নেওয়াদের ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠছে অদৃশ্য শত্রুর এই নয়া সংস্করণ।
তবে হ্যাঁ, ইঁদুরের উপর ওই পরীক্ষায় হাতে-গরম তথ্য এসেছে-- ভ্যাকসিন না থাকলেও, এর প্রকোপ আগের ভ্যারিয়েন্টগুলি যেমন ডেল্টা গামা ইত্যাদির চেয়ে কম। বুধবার জাপানি এবং আমেরিকান বিজ্ঞানীদের একটি বড় দলের তরফে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে এ সম্পর্কে। ওমিক্রনে ফুসফুসে ক্ষতি কম হচ্ছে, ওজন কম হ্রাস পাচ্ছে, এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা কম রয়েছে। জানানো হয়েছে রিপোর্টে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিজ্ঞানীরা সিরিয়া-র ধেড়ে ইঁদুরদের উপরেই বেশি নির্ভর করেছেন। সিরিয়ার এই সব ইঁদুর আগের সব কটি ভ্যারিয়েন্টেই মরমর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওমিক্রনে ঝড় সয়েছে অল্পের উপর দিয়ে। জানাচ্ছেন গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক ড. মাইকেল ডায়মন্ড। গবেষণা থেকে সামনে এসেছে-- ওমিক্রন নাক এবং শ্বাসনালীতে যে পরিমাণে হাজির হচ্ছে, তার একের দশ ভাগ থাকছে ফুসফুসে।
এ সম্পর্কিত আর একটি গবেষণা হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা করেছেন। তাঁরা আর ইঁদুরে থেমে থাকেননি। একেবারে মানুষের শ্বাসযন্ত্রের টিস্যু নিয়ে কারুকার্য করেছেন। ফুসফুসের বারোটি টিস্যুতে তাঁরা ওমিক্রন ছেড়ে দেখেছেন, ডেল্টা এবং অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক ধীরে বেড়ে উঠেছে স্যর ওমিক্রন। আবার, এও দেখতে পেয়েছেন, যদি শ্বাসনালীর টিস্যুতে ওমিক্রন চার্জ করা হয়, তার বৃদ্ধি ডেল্টাদের চেয়ে দ্রুত হচ্ছে।
করোনার সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সকলেই জানেন। নাক এবং মুখ দিয়ে এর সূত্রপাত। তার পর পৌঁছয় গলায়। এখানে থামলে সমস্যা তেমন থাকে না। কিন্তু করোনাভাইরাস ফুসফুসে গিয়ে খুনখারাপি শুরু করে দেয়, যেটা চিন্তা চরমে তোলে আমাদের, মৃত্যুর কারণও মূলত এই ফুসফুস-আক্রমণ। ওমিক্রনের গবেষণা সেই শক্তি কমের কথা জানিয়ে একটা স্বস্তি দিচ্ছে নিশ্চিত করেই। তবে এ হল গিয়ে বাবা করোনা, তার লীলাখেলা মানুষের বোঝার বাইরে, রহস্যের অন্তরে সে। স্বস্তির অনুভূতি নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে বেশি ওড়াউড়ি করলেই মুশকিল হয়ে যাবে! সতর্কতায় সামান্য শিথিল হয়ে নিশির ডাকে সাড়া দিলেই ঘোর অমঙ্গল!