Advertisment

শুভেন্দু-তৃণমূল জট অটুট, বঙ্গ রাজনীতিতে কেন চর্চায় অধিকারী গড়?

তৃণমূল সূত্রে খবর, দল ছাড়ার ব্য়াপারে ৬ মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুভেন্দু। নিজের সংগঠন বাড়ানোর কাজে মন দিয়েছেন তিনি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
suvendu adhikari, শুভেন্দু , শুভেন্দু অধিকারী

ছবি: পার্থ পাল।

তৃণমূল ছাড়বেন কি ছাড়বেন না? এই দোটানায় শুভেন্দু অধিকারীকে ঘিরে একুশের মহারণের আগে শীতের বাংলা রাজনৈতিক উত্তাপে একেবারে গনগনে। মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরই তৃণমূলে কাঁপুনি ধরিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে একেবারে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন কাঁথির অধিকারী বাড়ির অন্য়তম চর্চিত মুখ। তারপর শুভেন্দুকে ধরে রাখতে একেবারে মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করতে কম কসুর করছে না মমতা বাহিনী। শেষ রক্ষা হবে কি? ‘একসঙ্গে কাজ করা যাবে না’, হোয়াটসঅ্য়াপে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়কে পাঠানো শুভেন্দুর বার্তা নয়া ট্য়ুইস্টের জন্ম দিল।

Advertisment

মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফার পরই শুভেন্দু কি তৃণমূল ছাড়বেন? এ প্রশ্নে জল্পনার জল অনেক দূর গড়িয়েছে। এমন সময়ে তৃণমূলের ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর, অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের সঙ্গে শুভেন্দুর বৈঠক এ জল্পনায় একেবারে জল ঢেলে দেয়। যেখানে বৈঠক শেষে সৌগত রায় জানিয়ে দেন, দলনেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে শুভেন্দুর। আর এতেই নাকি মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটে।

শুভেন্দু ‘তৃণমূলেই ছিলেন, আছেন, থাকবেন’, দিনভর সংবাদমাধ্য়মে মমতা বাহিনীর এহেন ‘প্রচারে’র মাঝেই আচমকা সৌগত রায়কে পাঠানো শুভেন্দুর হোয়াটসঅ্য়াপ বার্তা এই পর্বে একেবারে নাটকীয় মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

শুভেন্দু অধিকারীর মতো একজন ‘হেভিওয়েট’ নেতা যদি শেষমেশ সত্য়ি সত্য়িই তৃণমূল ত্য়াগ করেন, তাহলে কী প্রভাব পড়বে মমতার দলে, সে হিসেবনিকেশ চলছে রাজনীতির ময়দানে। কিন্তু কেনই বা শুভেন্দুকে নিয়ে এত মাথাব্য়থা তৃণমূলের? কাঁথির অধিকার গড় কেনই বা বঙ্গ রাজনীতিতে এত আলোচিত?

আরও পড়ুন: কী করবেন শুভেন্দু? ‘মাথাব্যথা’ তৃণমূলের, অঙ্ক কষছে বিজেপি

হাওড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব শাখায় লোকাল ট্রেনে চেপে যদি আপনি খড়গপুরের দিকে এগোন, তাহলে দেউলটির পর রূপনারায়ণ নদ পেরোলেই আপনি পা রাখবেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। এই জেলার মাটিতেই গর্জে উঠেছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মতো বঙ্গ রাজনীতির অন্য়তম চর্চিত ঘটনা। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম দুর্গ দুরমুশ করে বাংলায় ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার’-এর ক্ষমতায় আসার নেপথ্য়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে শুভেন্দুর ‘বড়’ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য় বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের। শুধু শুভেন্দু একা নন, বাংলা রাজনীতি তাঁর বাবা, ভাইদের দাপটও নেহাত কম নয়।

শিশির অধিকারীর উত্থান:

শিশির অধিকারীর হাত ধরে বাংলা রাজনীতিতে পা রাখে কাঁথির অধিকারী পরিবার। ৭৯ বছর বয়সী এই প্রবীণ নেতা লোকসভায় তিনবারের সাংসদ। কংগ্রেসের হাত ধরে রাজনীতি শুরু করেছিলেন শিশিরবাবু। তারপর ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের হাতে তৈরি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে কাঁথি দক্ষিণ কেন্দ্রে কংগ্রেস বিধায়ক হিসেবে প্রথমবার বিধানসভায় পা রাখেন শিশির অধিকারী। ২০০১ সালে ওই কেন্দ্রে ফের নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৬ সালে এগরার বিধায়ক হন।

২০০৯ সালে কাঁথি কেন্দ্রে তৃণমূলের সাংসদ হয়ে দিল্লি পাড়ি। ইউপিএ ২ সরকারে গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী পদে দায়িত্ব সামলান। ওই একই কেন্দ্র থেকে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে তৃণমূলের সাংসদ নির্বাচিত হয়ে জয়ের ধারা অটুট রাখেন শিশিরবাবু।

শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু অধিকারী।

রাজনীতিতে অধিকারী ভাইদের উত্থান:

বাবার মতোই রাজনীতিতে পা রাখেন রাজ্য়ের প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী। কংগ্রেসের হাত ধরেই রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে শুভেন্দুর। প্রথম থেকেই শুভেন্দুর সাংগঠনিক দক্ষতা নজর কেড়েছিল। কাঁথির প্রভাত কুমার কলেজে ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। বাবার সঙ্গেই সমবায় আন্দোলনে শামিল হন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে কাঁথি পুরসভার কাউন্সিলর হয়েছিলেন শিশির-পুত্র।

১৯৯৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কাঁথি কেন্দ্রে তৃণমূলের টিকিটে নীতীশ সেনগুপ্তের প্রচারের গুরুদায়িত্ব সামলেছিলেন শুভেন্দুই। ২০০১ সালে তৎকালীন মুগবেড়িয়া কেন্দ্রে বিধানসভা নির্বাচনে লড়ে কিরন্ময় নন্দীর কাছে হেরে যান।

২০০৪ সালে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে লড়েন। কিন্তু সেবার দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের কাছে হেরে যান। এরপর সাফল্য় আসে ২০০৬ সালে। বাবার কেন্দ্র কাঁথি দক্ষিণ থেকে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে বিধানসভায় পা রাখেন শুভেন্দু। ৩ বছর পর ২০০৯ সালে ফের তমলুকে লোকসভা নির্বাচনে লড়ে ২০০৪ সালের হারের বদলা নেন শুভেন্দু। সেবারও শুভেন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। ২০১৪ সালেও ওই কেন্দ্রে জয় ধরে রাখেন শুভেন্দু।

২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের বিধায়ক নির্বাচিত হন। মমতা মন্ত্রিসভায় পরিবহণ দফতরের ভার কাঁধে তুলে নেন শুভেন্দু।

২০০৯ সালে সাংসদ হওয়ায় শুভেন্দুর কাঁথি দক্ষিণ কেন্দ্র খালি হয়। সেখানে উপনির্বাচনে লড়ে জয়ী হন শুভেন্দুর ভাই দিব্য়েন্দু অধিকারী। এরপর ২০১১ ও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ফের জয় ধরে রাখেন দিব্য়েন্দু।

রাজ্য়ের মন্ত্রী হওয়ার পর তমলুক লোকসভা কেন্দ্র ছাড়তে হয় শুভেন্দুকে। উপনির্বাচনে লড়ে অধিকারী পরিবারের হাতে ওই কেন্দ্র ধরে রাখেন দিব্য়েন্দু। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনেও ওই কেন্দ্রে জয় পান দিব্য়েন্দু।

শুভেন্দুর আরেক ভাই সৌমেন্দু অধিকারী কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্য়ান পদে রয়েছেন।

আরও পড়ুন: মেসেজ ফাঁস-অবিশ্বাসের বাতাবরণ, নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ইঙ্গিত?

তৃণমূলে শুভেন্দুর উত্থান:

২০০৭ সালে তৃণমূলে অন্য়তম প্রধান মুখ হয়ে ওঠার দাবিদার হন শুভেন্দু। সে বছরই জমি অধিগ্রহণ ঘিরে রণভূমিতে পরিণত হয় নন্দীগ্রাম। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম দুর্গ দুরমুশ করে বাংলায় ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার’-এর ক্ষমতায় আসার নেপথ্য়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে শুভেন্দুর ‘বড়’ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য় বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের।

একের পর এক নির্বাচনে জয় সেইসঙ্গে সাংগঠনিক দক্ষতায় তৃণমূলের অন্য়তম প্রধান সৈনিক হয়ে ওঠেন শুভেন্দু। শুধু পূর্ব মেদিনীপুর জেলাই নয়, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেও শুভেন্দুর দাপট চোখে পড়ার মতো। এই ৪ জেলায় ৯টি লোকসভা কেন্দ্র ও ৬৩টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। শুভেন্দুর সাংগঠনিক দক্ষতাকে রাজ্য়ের অন্য় প্রান্তেও কাজে লাগিয়েছেন দলনেত্রী। জঙ্গলমহল, মালদা, মুর্শিদাবাদে দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের পর্যবেক্ষক ছিলেন শুভেন্দু। যদিও পরে সেই পদটি তুলে দেওয়া হয়। সম্প্রতি বাঁকুড়ায় গিয়ে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় বলেছেন, তিনিই তৃণমূলের পর্যবেক্ষক।

রাজনৈতিক বিশ্লষকদের মতে, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুর, হুগলি, হাওড়া (গ্রামীণ) এলাকাতেও শুভেন্দুর ক্য়ারিশমা রয়েছে। সবমিলিয়ে মোট ১১০টি বিধানসভা কেন্দ্রে শুভেন্দুর সমর্থন রয়েছে।

হলদিয়া বন্দর এলাকাতেও শুভেন্দুর প্রভাব নজর কাড়বে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্য়েও তাঁর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য়। সমবায় আন্দোলনে শুভেন্দুর যোগাযোগও গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন: শুভেন্দু ‘বেসুর’ হতেই উজ্জীবিত গেরুয়া শিবির, কী বলছেন বিজেপির হেভিওয়েটরা?

তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর মতান্তর কেন?

মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের উত্থানের জন্য়ই নাকি তৃণমূলের সঙ্গে শুভেন্দুর দূরত্ব-বৃদ্ধি, এমনটাই বলছেন তৃণমূলেরই নেতারা। দল পরিচালনায় ইদানিং অভিষেকের কাঁধে অনেক গুরুদায়িত্ব তুলে দিয়েছেন দলনেত্রী। যে সিদ্ধান্তে ‘মুখভার’ হয়েছে শুভেন্দুর। সে কারণেই দলের বৈঠক হোক কিংবা মন্ত্রিসভার বৈঠক, সবেতেই নিজেকে সরিয়ে রাখেন কাঁথির অধিকারী পরিবারের ছেলে।

শুভেন্দুকে হারালে কী ক্ষতি তৃণমূলের?

বছর ঘুরলেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তৃণমূলের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্ক থিতু না হয়ে যদি এমনটাই চলতে থাকে, তাহলে একুশের লড়াই কঠিন হতে পারে মমতা বাহিনীর জন্য়। একাধিক আসনে শুভেন্দুর যে দাপট রয়েছে, তাতে তাঁর সঙ্গে দলের দূরত্ব না ঘুচলে নয়া চ্য়ালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তৃণমূলকে। পূর্ব মেদিনীপুরের মতো রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় শুভেন্দুর বিকল্প খোঁজাও কঠিন হবে শাসকদলের জন্য়।

রাজনৈতিক মহলের ব্য়াখ্য়া, অধিকারী পরিবারের বাইরের কেউ সেখানে গিয়ে শুভেন্দুর ক্য়ারিশমাকে চ্য়ালেঞ্জ জানাতে পারবেন না। শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী ৩ বারের সাংসদ। তাঁর অন্য় দুই পুত্র দিব্য়েন্দু তমলুকের সাংসদ, সৌমেন্দু কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্য়ান। বিভিন্ন কমিটি ও কর্মী ইউনিয়নেরর মাথাতেও রয়েছে অধিকারী পরিবার।

তৃণমূল সূত্রে খবর, দল ছাড়ার ব্য়াপারে ৬ মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুভেন্দু। নিজের সংগঠন বাড়ানোর কাজে মন দিয়েছেন তিনি। তৃণমূল নেতাদের একাংশ বলছেন, যদি শুভেন্দু ও তাঁর পরিবার বিজেপিতে যোগ দেন, তাহলে শুধুমাত্র ১১০টি আসনেই তার প্রভাব পড়বে না, বরং ২৯৪টি আসনেই প্রভাব পড়তে পারে। দলের একটা বড় অংশ ‘দিদি’-কে ছেড়ে ‘দাদা’র হাত ধরতে পারে। যদিও দলের আরেক অংশের দাবি, সাংগঠনিক স্তরে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়াযের ক্য়ারিশমাকে ছুঁতে পারবেন না শুভেন্দু।

রাজনৈতিক মহলের ব্য়াখ্য়া, শুভেন্দু দল ছাড়লে কী ক্ষতি হতে পারে, তা আগাম আন্দাজ করেই তৃণমূল সুপ্রিমো বলেছেন যে, ২৯৪টি আসনে তিনিই দলের পর্যবেক্ষক।

Read the full story in English

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

tmc bjp Suvendu Adhikari
Advertisment