তাজমহল নিয়ে পুরনো বিতর্কই নতুন করে আঁচে ফুটতে শুরু করেছে। এই ফুটে ওঠার কারণ হল, তাজমহলের বন্ধ হয়ে থাকা ২২টি ঘর খুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল। মামলা করা হয়েছিল লখনউ বেঞ্চে। যদিও দুই বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় এবং সুভাষ বিদ্যার্থীর বেঞ্চ মামলা খারিজ করে দিয়েছে। মামলাকারীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে বিচারপতিরা বলেছেন, 'জনস্বার্থ মামলাকে এ ভাবে উপহাসে পরিণত করে দেবেন না।' তাঁদের কটাক্ষ,'এর পর তো আমাদের চেম্বার খুলে দেখতে চাওয়া হবে কী আছে!' মামলাকারীর নাম, রজনীশ সিং, তিনি অযোধ্যার বাসিন্দা। অযোধ্যা জেলা বিজেপির মিডিয়া ইনচার্জ।
কী দাবি রজনীশের
তাজমহলের ২২টি প্রকোষ্ঠ দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ। সেগুলি খুলে দেখা হোক কী আছে তার ভিতরে। দাবি, এটি আসলে 'তেজো মহা আলয়' নামে এক প্রাচীন শিবমন্দির। রজনীশের আবেদন ছিল, তাজমহলের 'প্রকৃত ইতিহাস' অনুসন্ধানে দায়িত্ব দেওয়া হোক আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআইকে। তারাই বন্ধ ঘর খুলে দেখুক সেখানে কী রয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা হোক, কোনও হিন্দু মন্দিরের কাঠামোয় সম্রাট শাহজাহান এই স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন কি না।
ইসলামিক স্মৃতিসৌধ না হিন্দু মন্দির?
ইন্দোরের সংস্কারপন্থী ইতিহাসবিদ পুরুষোত্তম নাগেশ ওক বা পিএন ওকের একটি বই রয়েছে। তাজমহল ইজ এ টেম্পল প্যালেস। এটিতে ওক তাজমহলকে হিন্দু প্রাসাদ হিসেবে প্রমাণের জোর সওয়াল চালিয়ে গিয়েছেন নানা যুক্তি তুলে ধরে। উদাহরণ দিয়ে। পাশাপাশি, তিনি এমনও বলেছেন, তাজমহল শিবমন্দির হতে পারে। ওকের বইটি নানা ভাষার মতো বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে। তার কুড়ি নম্বর অধ্যায় লেখা,'… বটেশ্বর শিলালিপি নামে পরিচিত একটি শিলালিপি লখনউ মিউজিয়ামে আছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া আছে যে, তাজমহল ১১৫৫ সালে নির্মিত শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি হিন্দু মন্দির।' তাজমহলের নানা কিছু তুলে তিনি শিবমন্দিরের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন। এই অধ্যায়েই এক জায়গায় ওক বলেছেন, 'মর্মরের উঁচু মঞ্চের পিছনে, লাল পাথরের উঠানের নীচে নদীর দিকে মুখ করে আছে দীর্ঘ একসার সুপরিসর কারুকার্য খচিত প্রকোষ্ঠ।
আরও পড়ুন Explained: উত্তরপ্রদেশে নতুন করে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক, কী সেই বিতর্ক, তার ইতিহাসই বা কী?
এর সঙ্গে আছে একটি লম্বা ঢাকা বারান্দা। যা ওই সারির পুরো দৈর্ঘ্য পর্যন্ত প্রসারিত। যেখানে মৃতদেহ রাখা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়, সেই নীচের কেন্দ্রীয় প্রকোষ্ঠের নীচের তলের এই প্রকোষ্ঠগুলিতে কারুকার্য থাকত না যদি তাজমহল সত্যিই মুসলিম কবর হত।… আবার নদীর দিকে মুখ করা লাল পাথরের চত্বরের নীচের সারিবদ্ধ ঘরগুলির বায়ুরন্ধ্রের অনুরূপ দরজাকৃতির মুখও দেওয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সব কুশ্রী বাধা যদি অপসারিত হয়, যমুনা নদীর ঠান্ডা বাতাস এবং সূর্যালোকে উদ্ভাসিত নানা রংয়ে চিত্রিত তাজমহলের এই নীচের তলার কক্ষগুলি দর্শকের আনন্দের কারণ হতে পারে, যেমনটি হত শাহজাহানের আমলের আগে।' তাজমহল নামকরণ নিয়ে তিনি এর ঠিক পরেই এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, 'তাজমহল কথাটিও ফার্সি থেকে অনেক দূর। এটি একটি সংস্কৃত শব্দ 'তেজ মহা আলয়' অর্থাৎ উজ্জ্বলতম প্রাসাদ কথাটির অপভ্রংশ।… এই নামটা আরও দেওয়া হয়েছে এই জন্য যে, শিবের নেত্র থেকে তেজ বা জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয় বলে ধারণা করা হয়।'
এই বইয়ের প্রথমাংশে তাজমহলকে হিন্দু প্রাসাদ হিসেবে প্রমাণ করার যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন ওক, তার একটি জায়গায় তিনি বলেছেন, 'এই মর্মর প্রাসাদের চারপাশে আছে এক বিরাট লালপাথ বিছানো চত্বর। এর নীচেই আছে এক প্রকাণ্ড ভবন, অনেক কক্ষ নিয়ে। জনসাধারণের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে অনুরোধ করা উচিত, যাতে এই নীচের তলার কক্ষগুলি উন্মুক্ত করে দেখানো হয়। এটা খুবই সম্ভব যে, মাটি আর বালিতে ভর্তি এই ঘরগুলিতে ধনরত্ন বা মূর্তি বা হিন্দু উৎসের কোনও প্রমাণ থাকতে পারে।'
পিএন ওকের এই তত্ত্বকে অস্ত্র করে ২০১৫ সালে সাত জন আইনজীবী তাজমহল অঞ্চলের ভিতরে দর্শন এবং আরতির অনুমতি চেয়ে মামলা করেন আগ্রা সিভিল কোর্টে। প্রকোষ্ঠগুলি খুলে দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা। ২০১৭ সালে জাতীয় তথ্য কমিশনার এই স্থাপত্যটি মন্দির না স্মৃতিসৌধ, তা স্পষ্ট করতে বলে সরকারকে। সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে মামলার আবেদন জানানো হলেও, তা খারিজ হয়ে যায়।
যদিও ইতিহাস বলছে, বেগম মমতাজের স্মৃতি-রক্ষায় ১৬৩১ সালে শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ শুরু করেন। ২২ হাজার শ্রমিকের হাড়ভাঙা শ্রমে তা শেষ হয় ২২ বছর পর, ১৬৫৩ সালে। ফলে পি এন ওকের বক্তব্যের সঙ্গে বহু পুরাতাত্ত্বিক তীব্র ভিন্ন মত পোষণ করেন। তা ছাড়া, পিএন ওকের এমনও দাবি যে, হিন্দুত্ব থেকেই জন্ম নিয়েছে খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম। ভ্যাটিক্যান সিটি, কাবা, ওয়েস্টমিস্টার অ্যাবি এসবও নাকি শিবের মন্দিরই ছিল। যা অনেকেরই মতে, হাস্যকর উবাচ।
এই দাবিদাওয়ার মধ্যে নতুন ঢেউ তুলেছেন রাজস্থানের জয়পুর রাজপরিবারের রানি দিয়া কুমারী। তিনি বিজেপির লোকসভার সদস্য। জয়পুরের শেষ মহারাজা মান সিংয়ের নাতনি। দিয়ার দাবি, যে জমিতে তাজমহল তা ছিল রাজপুত রাজপরিবারের। সে সংক্রান্ত কাগজপত্রও নাকি তাঁদের কাছে রয়েছে।
তাজমহল আসলে হিন্দু মন্দির এই দাবি নতুন করে হাওয়া পেয়েছে যেমন, তেমনই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একাংশ ভেঙে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল বলে যে দাবি, তা জোরদার এখন। কোর্টের নির্দেশের পুরাতত্ত্ব বিভাগ সে সংক্রান্ত সমীক্ষাও করছে।
এমন যখন টানাপোড়েনের ঝড়, তখন একটি কথা শেষে বলে নিতে হবে। প্লেসেস অফ ওরশিপ অ্যাক্ট, ১৯৯১। অর্থাৎ উপাসনাস্থান আইন, ১৯৯১। যখন রামমন্দির আন্দোলনের হাওয়া অতিপ্রবল, তখন নরসিংহ রাওয়ের সরকার এই আইন আনে। যে আইন বলছে, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা দিবস থেকে ভারতের যেখানে যে উপাসনাস্থান ছিল, তার কোনও ধর্মীয় পরিবর্তন করা যাবে না। তবে এই আইনের বাইরে রাখা হয় অযোধ্যার রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদকে। রামজন্মভূমি নিয়ে মামলা মিটে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে তৈরি হচ্ছে রামমন্দির, কিন্তু বাকি কোনও উপাসনাস্থানের ধর্মীয় চরিত্র বদলের পথে যে আইনেরই বাধা রয়েছে, তা হলে?