করলো করলো চারো ধাম/ মিলেঙ্গে কৃষ্ণ মিলেঙ্গে রাম। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী। চার ধামের মধ্যে যোগাযোগের পথ প্রশস্ত করা নিয়ে বিতর্ক সপ্তমে। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। রাস্তা প্রশস্ত হলে পরিবেশের বিনাশ হবে, মামলাকারীর বক্তব্য এটাই। কোর্টের সিগন্যালও প্রাথমিক ভাবে প্রায়-রেড। তবে, রায় পুনর্বিবেচনার জন্য কেন্দ্রের তরফে আবেদন করা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে, সেপ্টেম্বরে। বৃহস্পতিবার, শীর্ষ আদালত অবশ্য রায়-ঘোষণা স্থগিত রেখেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও এই মামলায় রয়েছে, কারণ পথের হালবদলে সীমান্ত-সুরক্ষায় তাদেরও সুবিধা। যদিও অভিযোগ, প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনেকটা কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে।
সড়কপথ পরিবহণ এবং হাইওয়ে মন্ত্রক বা মিনিস্ট্রি অফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টের ঘাড়ে রয়েছে (MoRTH) রাস্তা প্রশস্ত করার এই গুরুভার। প্রকল্পটি চার ধাম মহামার্গ বিকাশ পরিযোজনায় হচ্ছে। রায় সংরক্ষিত রেখে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, পরিবেশ এবং প্রতিরক্ষার মধ্যে কোনও লড়াই নেই। দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতেই হবে আমাদের।
প্রকল্পের অ-আ-ক-খ
কেন্দ্রীয় সরকারের বিরাট উদ্যোগ এই পথ সম্প্রসারণ প্রকল্প। ১২ হাজার কোটির বাজেট, যার বিসমিল্লাহ হয়েছে ২০১৬ সালে। পর্বত কেটে ৮৮৯ কিলোমিটার পথ প্রশস্ত করাই কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সব সময়ে চার ধামের মধ্যে যোগাযোগ সহজ এবং সুচারু করে তোলা উদ্দেশ্য। তা ছাড়া সীমান্তে সেনার যাওয়াআসা সুগম করার ভাবনা। ২০১৬-র ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এর শিলান্যাস করেন। মোদীজি বলেন, উত্তরাখণ্ডে হড়পা বানে মারা গিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতি এই প্রকল্প শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁরা বলছেন, সম্প্রসারণ খোদার উপর খোদকারি, রাস্তা বাড়াতে গিয়ে ডেকে আনা হবে ভূমিধ্বস, হড়পা বান।
বিতর্ক
১৯১৮ সালে একটি এনজিও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। তাদের সাফ কথা, হিমালয় পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্রের বিনাশের সবুজসংকেত দিচ্ছে এটি, তাই সম্প্রসারণ-প্রকল্প বাতিল করা হোক। বলেছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গাছের সাড়ে সত্যানাশ হবে। পাহাড় কাটতে হবে, ধস-আশঙ্কা বৃদ্ধির পরিসর বাড়িয়ে। খোঁড়াখুঁড়ি-কাটাকাটিতে বিপুল পথরমাটি উঠবে, তাতেও তো পরিবেশে ধাক্কা। হিতের ঠেলায় অন্তহীন অহিত। পরিকল্পনায় ক্ষয়ক্ষতির পর্বতাকার মেঘ ঘনিয়ে তুলবে পাহাড় চূড়ায়। তৈরি হবে আতঙ্ক।
সুপ্রিম কোর্ট একটি হাই-পাওয়ার কমিটি বা এইচপিসি গঠন করে দিয়েছে মামলায়। যার নেতৃত্বে নামী পরিবেশ-কর্মী রবি চোপড়া। এই কমিটি ২০২০ সালের জুলাইয়ে দুটি রিপোর্ট জমা দেয়। কারণ, এর সদস্যদের মধ্যে তৈরি হয় মতপার্থক্য।
সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট চোপড়া সহ এইচপিসি-র চার জনের রিপোর্টেই সিলমোহর দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল, গাড়িগোড়া চলাচলের পথ অর্থ্যাৎ ক্যারেজওয়ের প্রস্থ ৫.৫ মিটার (১.৫ মিটার ফুটপাত সহ) করা যাবে। মিনিস্ট্রি অফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টের পর্বতাঞ্চলে হাইওয়ে তৈরির যে গাইডলাইন, সেই অনুযায়ী এইটুকুই সম্ভব। এইচপিসি-র সিংহ ভাগ, ২১ জন, এর মধ্যে ১৪ জন আবার সরকারি আধিকারিক, তাঁরা প্রকল্প অনুযায়ী ১২ মিটার প্রশস্ত রাস্তার পক্ষে। যাতে থাকবে দুটি লেন। ক্যারেজওয়ে ৭ মিটার। দুই দিকে পেভড শোল্ডার থাকবে ১.৫ মিটার করে। দু'পাশে ১ মিটারের অতিরিক্ত শোল্ডারও থাকবে। পাহাড়ের দিকে সেই শোল্ডারে বা বাড়তি পরিসরে হবে ড্রেন, উপত্যকার দিকে দুর্ঘটনার প্রতিরোধে তৈরি করা হবে ক্র্যাশ ব্যারিয়ার। ফলে, এটা স্পষ্টই এত চওড়া রাস্তা তৈরি করতে গেলে পাহাড় কাটতে হবে অনেক, বিস্ফোরণ ঘটানোর দরকার পড়বে লাগাতার, তৈরি করতে হবে অনেক টানেল, গাছ কাটতে হবে। পরিবেশবিদদের অনেকেই বলছেন, হবে না চলছেই। নির্লজ্জ ভাবে নিয়মভঙ্গ করে তৈরি করা হচ্ছে এই প্রকল্পের পথ।
নো রুল অফ ল
এইচপিসি-র চেয়ারম্যান রবি চোপড়া পরিবেশ মন্ত্রককে একটি চিঠি লিখেছিলেন অগস্ট, ২০২০-তে। সেখানে তিনি বলেছেন, প্রকল্পটি এমন ভাবে বাস্তবায়িত করা হচ্ছে যেন কোনও আইনের শাসনই নেই। চিঠিতে কী লিখেছিলেন তিনি? সারাংশটি বলা যেতে পারে। যা রীতিমতো আক্রমণাত্মকও।
কাজ হয়েছে বৈধ অনুমতি ছাড়াই: প্রকল্প অনুযায়ী যোগ করতে হবে ২৫০ কিলোমিটার রাস্তা। ফলে বিরাট উদ্যোগে গাছ কাটা হয়েছে বেআইনি ভাবে। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে উত্তরাখণ্ড রাজ্য বন দফতর তরফে প্রকল্পে যে ওয়ার্কঅর্ডার দেওয়া হয়েছিল, তা বেআইনি। যদিও দফতরের তরফে নির্মাণকারী সংস্থাকে বলা হয়, 'চার ধাম প্রকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয়ে রয়েছে… নানা স্থানে বৃক্ষচ্ছেদনে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।'
পুরনো ছাড়পত্রের অপব্যবহার: ২০০২ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের তরফে যে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতে কাজ শুরু হয়েছে। যা বেআইনি। বিপুল পরিমাণে পাহাড় কাটা হয়েছে এতে। ১২৫ নম্বর জাতীয় সড়কের ঢাল দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে পাহাড় কাটার ফলে উঠে আসা মাটিপাথরের বর্জ্য। যা প্রকৃতি এবং স্থানীয় মানুষজনের বাসস্থানের পক্ষে অতি-ক্ষতিকর।
মিথ্যা ঘোষণা: ২০০ কিলোমিটারের বেশি নির্মাণের ক্ষেত্রে গাছ কাটা, পাহাড় কাটা ইত্যাদি প্রাকৃতিক ভাবে সংবেদনশীল এলাকা কেদারনাথ অভয়ারণ্য, রাজাজি জাতীয় উদ্যান এবং ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের মধ্যে হবে না, এমনটা বলা হয়েছিল।
ছাড়পত্র না নিয়েই কাজ: বেশ কিছু অঞ্চলে, অন্তত ৬০ কিলোমিটারে, কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে কোনও ছাড়পত্র ছাড়াই। কারণ, বন দফতরে ছাড়পত্রের আবেদন কোনও কারণ না দর্শিয়েই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা লঙ্ঘন: অন্তত ৫০ কিলোমিটারের মতো রাস্তায় কাজ শুরু হয়েছে, যদিও রাজ্য হলফনামা দিয়ে আদালতে জানায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা আনুযায়ী ওই সব রাস্তায় কাজ হবে না।
আরও পড়ুন জানেন পৃথিবীতে প্রাণের মহাবিনাশের কারণ কী?
সেনার বক্তব্য
পরিবেশের কারণে প্রকল্পটি ধাক্কা খেলেও, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সমর্থনের কোনও খামতি হয়নি। তারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়ে বলেছে, ৭ মিটার ক্যারেজওয়ে থাকা রাস্তায় (প্রয়োজনে ৭.৫ মিটার) সেনা চলাচল সহজ হবে। প্রাথমিক ভাবে এই প্রকল্প চার ধামের তীর্থযাত্রীদের জন্য হলেও, চিন সীমান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সেনা-সুবিধাও এই সম্প্রসারণের কৌশলগত দিক, যা অতি গুরুত্বপূর্ণও। ফলে সেই সওয়াল চলেছে আদালতে। ইন্দো-চিন সীমান্তে সুরক্ষার প্রশ্নটি কতটা জরুরি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক হলফনামায় তা তুলে ধরেছে। রবি চোপড়া এর উত্তরে বলেন, পরিবেশের ক্ষতি হবে, তার প্রভাব পড়বে আগামী প্রজন্মের উপর, সেই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
পরিবেশ না প্রতিরক্ষা, পরিবেশ না পর্যটন? 'প' দিয়ে শুরু শব্দগুলি একে অপরের সঙ্গে লড়াইয়ে। তরজায়। কিন্তু যখন হুহু করে উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবী। মহাপ্রলয়ের ধ্বজাটা উড়ে গিয়েছে, তখন পরিবেশের জয় পাওয়াই উচিত। বা এমন একটি পথ বার করতে হবে, যেখানে পরিবেশের গায়ে কোনও আঁচ লাগবে না, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও মিটবে। বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অনেকেই। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে সবুজ-বিজয়ের আশায় রয়েছেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন