আমরা কোভিডের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ২০২০-২১ কাটিয়ে ২২-এ এসে গিয়েছি। বিষ কবে যাবে করোনার, সেই আলোচনা চলছে জোরদার। কিন্তু অন্য অসুখ নিয়ে, তাদের ছোবল নিয়ে কথাবার্তা কম হচ্ছে খুবই। কোভিডের বড় হাঁ-য়ে সব ঢুকে গিয়েছে যেন। এবং সেই হাঁ-য়ের ভিতর থেকে চিমটে দিয়ে টেনে কয়েকটি অন্য অসুখকে বার করে দেখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড় হয়েছে এখন। কারণ তাদের বাড়বৃদ্ধি এমনই মারাত্মক! এর মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ওষুধের কাজ না করার কাহিনি। এই লেখার বিষয় সেটাই।
১৯ জানুয়ারি, বিখ্যাত মেডিকাল জার্নাল ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি উদ্বেগ-জাগানো লেখায় জানানো হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ব্যাক্টেরিয়ার রেজিট্যান্স বা প্রতিরোধ এমন চরমে উঠেছে যে, তাতে মৃত্যু মাত্রা ছাড়িয়েছে। ল্যানসেটের প্রবন্ধ বলেছে, মৃত্য়ুসংখ্যাটা ২০১৯-এ ১.২৭ মিলিয়ন বা ১২ লক্ষ ৭০ হাজার। ব্যাক্টেরিয়ার ওষুধ প্রতিরোধ বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স, সংক্ষেপে এএমআরের এই সুনামি, ২০৪টি দেশের বিচারে ওই মৃত্যুসংখ্যা জানানো হয়েছে। সংখ্যাটা পৃথিবী জোড়া এইচআইভি অথবা ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর চেয়েও বেশি।
একটু তলিয়ে দেখা যাক
প্যাথোজেন বা রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু, অসংখ্য ছড়ানো চারদিকে, শরীরের মধ্যেও রয়েছে বহু। ২৩টি তেমন ধারাল জাতীয় প্যাথোজেন এবং সেই সংক্রান্ত ওষুধে উপর আতসকাচ ফেলেছিলেন গবেষকরা। অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স বা এএমআরের ফলে সরাসরি ১২.৭ লক্ষের মৃত্যু হয়েছে, এই তথ্য যেমন উঠে এসেছে, তেমনই এ সম্পর্কিত কারণে মৃত্যু হয়েছে আরও ৪৯ লক্ষ ৫০ হাজারের। মানে, দ্বিতীয় স্তরের মৃত্যুমিছিলে সরাসরি এএমআর নেই, কিংবা ব্যাক্টেরিয়া রেজিস্ট্যান্স পরোক্ষ কারণ হিসেবে এসেছে। এর পাশে যদি এইচআইভি/এডস এবং ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুসংখ্যাটা রাখা যায়, তা হলে বোঝা যাবে এই ফিগারটা কতটা বড়। ২০১৯-এ এডসে ৮ লক্ষ ৬০ হাজার এবং ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু ৬ লক্ষ ৪০ হাজারের।
যে ২৩টি প্যাথোজেন নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে, তার মধ্যে ছ'টির (E coli, S aureus, K pneumoniae, S pneumoniae, A baumannii, and P aeruginosa) ওষুধ প্রতিরোধ মারাত্মক মাত্রায় পৌঁছেছে, সরাসরি এর ফলে মৃত্যু হয়েছে ৯ লক্ষ ২৯ হাজার, পরোক্ষে-- ৩৫ লক্ষ ৭০ হাজার। এর মধ্যে মেথিসিলিন-রেজিস্ট্যান্ট স্ট্যাফিলোককাস অরেয়াসে (Methicillin-resistant Staphylococcus aureus) মৃত লক্ষাধিক। এখানে মেথিসিলিন-রেজিস্ট্যান্ট স্ট্যাফিলোককাস অরেয়াস সম্পর্কে একটু না বললে বোঝানো যাবে না বিষয়টি কী মারাত্মক এবং কোথা থেকে কোথায় পৌঁছয়। মেথিসিলিন-রেজিস্ট্যান্ট স্ট্যাফিলোককাস অরেয়াস বা এমআরএসএ (MRSA),মার্সাও বলা হয়ে থাকে। এর মানে হল এই স্ট্যাফিলোককাস ব্যাক্টেরিয়াকে মারতে পারছে না মেথিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক্স। প্যাথোজেনটি মেথিসিলিন-রেজিস্ট্যান্ট।
স্ট্যাফিলোককাসকে অপারচুনিস্টিক প্যাথোজেন বা সুযোগ সন্ধানী জীবাণু বলা হয়। এরা ত্বক-নাকের ভিতরে থাকে, কোনও ক্ষতি করে না সাধারণত, কিন্তু ত্বকের ভিতরে ঢুকে গেলে অনেক সময়ে সমস্যা সীমা ছাড়ায়, সংক্রমণ হতে থাকে। মোটামুটি যা লাল লাল ফুসকুড়ি বা ব্রণর মতো দেখতে থাকে প্রাথমিক অবস্থায়, মনেই হবে না কোনও অসুখে যে, কিন্তু বাড়তে বাড়তে তাই কখনও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এখন মেথিসিলিন অস্ত্রে স্ট্যাফিলোককাস মারা হয়, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে না অনেক সময়ে, ফলে তাকে মেথিসিলিন-রেজিস্ট্যান্ট স্ট্যাফিলোককাস অরেয়াস বলা হচ্ছে। তা ছাড়া, গুরুতর সংক্রমণ রুখতে দুই শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক্স ব্যবহার করা হয়, ফ্লুওরোকুইনোলোন্স এবং বিটা-ল্যাকটাম। দেখা যাচ্ছে, এই অ্যান্টিবায়োটিক্সের প্রতিরোধে পটু হয়ে উঠেছে প্যাথোজেনের দল। ল্যানসেটে প্রকাশিত মৃত্যুসংখ্যার ৭০ শতাংশেরই এর ফলে।
কোভিডে অ্যান্টিবায়োটিক্স
কোভিডের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক্সের অতি-ব্যবহার একট বড় সমস্যা। এতে এক রোগ সারাতে গিয়ে আর এক রোগ ডেকে আনা হচ্ছে। আইসিএমআরের অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স বিষয়ক প্রোগ্রাম অফিসার কামিনী ওয়ালিয়া বলছেন, '১০টি হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে আইসিএমআর জেনেছে, অর্ধেকের বেশি কোভিড রোগী, ধরুন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ, ওষুধে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে মারা গিয়েছেন।' তাঁর এও বক্তব্য, ' এই তথ্য পাওয়া তেমন সহজ হয়নি, কারণ বেশির ভাগ হাসপাতালেরই যাকে বলা হয় ইনফর্মেশন সিস্টেম, তা নেই। ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট তথ্য পেতে গেলে রোগীদের ল্যাব রিপোর্টের সঙ্গে ক্লিনিকাল রিপোর্টকে যুক্ত করতে হবে।'
আরও পড়ুন সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে N95 মাস্কই কেন সেরা, কী বলছে গবেষণা?
কো-মর্বিডিটি
কোভিড-সময়ে কো-মর্বিডিটি শব্দটি এখন সবার মুখে মুখে। কেউ কোনও গুরুতর অসুখ যেমন এডস, ক্যান্সার ইত্যাদিতে
ভুগছেন এবং কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁর রোগ প্রতিরোধ শক্তি তলানিতে, কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তিনি পারছেন না। পারলেন না, তাঁর মৃত্যু হল। এটাই কো-মর্বিডিটিতে মৃত্যু। এখন ওই ব্যক্তির প্রতিরোধ শক্তি কমই শুধু নয়, তিনি বেশ কিছু ওষুধেও সাড়া দিচ্ছিলেন না, মানে গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদি অসুখ থাকার ফলে বেশ কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে, তাতে ওই সব ওষুধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে তাঁর দেহে, যা চিকিৎসায় বড় একটি বাধা নিশ্চিত ভাবেই। বিশেষ করে স্টেরয়েডস আগে থেকেই যথেষ্ট পরিমাণে তিনি খেয়ে থাকেন যদি, তা হলে কোভিডের প্রদাহ রুখতে স্টেরয়েডস দেওয়া হলেও তিনি সাড়া কম দেবেন বা এমনও হতে পারে সাড়াই দিলেন না। আবার, কোভিডের ইনফ্ল্যামেশন রুখতে গাদা গাদা স্টেরয়েডসের দেওয়ায় ইমিউনো কম্প্রোমাইজড বা রোগ প্রতিরোধশক্তির করুণ অবস্থায় তিনি পৌঁছছেন, ফলে মৃত্যু হল।
তাই অ্যান্টিবায়োটিক্স যখন-তখন খাবেন না। কিছু হলেই ডাক্তার না দেখিয়েই টুপ করে এটি খেয়ে নেওয়াটা তো গর্হিত কাজ। তাতে কোনও গৃহস্থ ব্যাক্টেরিয়ার হাতে মারা পড়তে পারেন, একেবারে বেঘোরে।