‘রাজনীতির মঞ্চে দেখা হবে...আমি ভয় পাই না’- একুশে মহাযুদ্ধের আগে নিজের দল তৃণমূলে কাঁপুনি ধরিয়ে তুফান তুলেছেন এই মুহূর্তে বঙ্গ রাজনীতির অন্য়তম চর্চিত মুখ শুভেন্দু অধিকারী। মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের ছবি ছাড়াই, তৃণমূলের ব্য়ানার বাদ দিয়েই বঙ্গভূমিতে একের পর এক কর্মসূচি করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কাঁথির অধিকারী গড়ের এই অন্য়তম প্রধান সৈনিক। ‘মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়’ নাম তো নেননি। মাঝেমধ্য়ে ‘দলনেত্রী’ মুখ দিয়ে বেরোলেও সম্প্রতি নন্দীগ্রামের মতো ধাত্রীভূমিতে দাঁড়িয়ে যে উচ্চস্বরে ‘ভারত মাতা কী জয়’ স্লোগান দিয়েছেন, তাতে একুশের মহাযুদ্ধের মুখে শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক ভবিষ্য়ৎ ঘিরে তুমুল চর্চা চলছে। শুভেন্দু কি তৃণমূলে ‘রুষ্ট’? তবে, কি মমতার অন্য়তম এই সৈনিকও বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন?
যাঁকে ঘিরে এত চর্চা-জল্পনা, সেই শুভেন্দু অধিকারী আদতে কেমন নেতা?
তৃণমূলে যোগদানের আগে পূর্ব মেদিনীপুর অধিকারী পরিবার ছিল কংগ্রেসের হাতে। সালটা ১৯৯৮। সে বছরই তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। তারপর থেকেই মমতার দলের ‘একনিষ্ঠ’ সদস্য় কাঁথির অধিকারী পরিবার। তিনবারের সাংসদ শিশির অধিকারীর পুত্র শুভেন্দু। ইউপিএ ১ ও ইউপিএ ২ আমলে সাংসদ নির্বাচিত হন শুভেন্দু। ২০০৭ সালে তৃণমূলে অন্য়তম প্রধান মুখ হয়ে ওঠার দাবিদার হন শুভেন্দু। সে বছরই জমি অধিগ্রহণ ঘিরে রণভূমিতে পরিণত হয় নন্দীগ্রাম। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম দুর্গ দুরমুশ করে বাংলায় ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার’-এর ক্ষমতায় আসার নেপথ্য়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে শুভেন্দুর ‘বড়’ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য় বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের।
২০০৯ সালে তমলুকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠকে হারিয়ে নজির গড়েন শুভেন্দু। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়ের ধারা অটুট রাখেন শিশির-পুত্র। এরপর ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আরও সাফল্য় পান শুভেন্দু। নন্দীগ্রাম কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন শুভেন্দু। মমতা মন্ত্রিসভায় পরিবহণ দফতরের ভার কাঁধে তুলে নেন শুভেন্দু।
এত সাফল্য়ের মধ্য়েও ‘আঁচড়’ লাগে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এ সময় সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি মামলায় শুভেন্দু অধিকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। নারদকাণ্ডে ‘বিতর্কিত’ ফুটেজেও দেখা যায় শুভেন্দুকে।
আরও পড়ুন: ‘চেনা বামুনের পৈতে লাগে না, রাজনীতির লড়াইয়ে দেখা হবে’, নন্দীগ্রাম দিবসে সুর চড়ালেন শুভেন্দু
বঙ্গ রাজনীতিতে শুভেন্দু কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
গ্রামীণ বাংলায় তৃণমূলস্তরের নেতা শুভেন্দু। জনসংযোগে তাঁর জুরি মেলা ভার। গ্রামীণ বাংলার মানুষের সঙ্গে তাঁর টান সর্বজনবিদিত। পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের আধিপত্য় কায়েমে শুভেন্দুর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য় বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। পূর্ব মেদিনীপুরে ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন শুভেন্দুই। শুধু এই জেলাতেই নয়। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা জেলাতেও শুভেন্দুর দাপট উল্লেখযোগ্য়। দলের পর্যবেক্ষক হিসেবে মুর্শিদাবাদ, মালদা জেলায় কংগ্রেস দুর্গ তছনছ করার নেপথ্য়ে শুভেন্দুর ভূমিকা নজর কেড়েছে বাংলা রাজনীতির অলিন্দে।
গত বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ‘উত্থান’ ও তৃণমূলের ভরাডুবির পরও উনিশ সালের শেষে রাজ্য়ের ৩ বিধানসভা উপনির্বাচনে মমতার দলের সাফল্য়ের পিছনেও শুভেন্দুর হাত রয়েছে।
তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কেন?
মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের উত্থানের জন্য়ই নাকি তৃণমূলের সঙ্গে শুভেন্দুর দূরত্ব-বৃদ্ধি, এমনটাই বলছেন তৃণমূলেরই নেতারা। দল পরিচালনায় ইদানিং অভিষেকের কাঁধে অনেক গুরুদায়িত্ব তুলে দিয়েছেন দলনেত্রী। যে সিদ্ধান্তে ‘মুখভার’ হয়েছে শুভেন্দুর। সে কারণেই দলের বৈঠক হোক কিংবা মন্ত্রিসভার বৈঠক, সবেতেই আজকাল গরহাজির থাকছেন কাঁথির অধিকারী পরিবারের ছেলে।
সম্প্রতি নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে বার্তা দিয়েছেন শুভেন্দু এবং তাঁর পাল্টা হিসেবে সেই ‘ধাত্রীভূমি’তে গিয়েই যে বক্তব্য় পেশ করেছেন ফিরহাদ হাকিম, দোলা সেনরা, তাতে শুভেন্দু বনাম তৃণমূল দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
ক’দিন আগে বিজয়ার আমন্ত্রণপত্রে গেরুয়া রঙের ছোঁয়া। সেইসঙ্গে রাজস্থানের পাগড়ি পরা শুভেন্দুর ছবিও জল্পনা দ্বিগুণ করেছে।এমনকি, সম্প্রতি তাঁর একাধিক মন্তব্য় ঘিরে শোরগোল পড়েছে রাজনৈতিক মহলে। যেমন কিছুদিন আগেই শুভেন্দুর তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি প্য়ারাশুটে নামিনি, লিফটে করেও উঠিনি। সিঁড়ি ভাঙচে ভাঙতে উঠে এসেছি’’। আবার মমতার অন্য়তম সৈনিককে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘দম্ভের লড়াইয়ে বামেরা শেষ হয়ে গিয়েছিল। মানুষকে নিয়ে কাজ করুন। মানুষের আবেগ ও মন জিতলেই টিকে থাকা যায়’’। এমন ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা তিনি কাকে দিচ্ছেন? এমন মন্তব্য় করে আদতে শুভেন্দু ঠিক কী বার্তা দিতে চাইছেন? এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা তুঙ্গে।
আরও পড়ুন: ‘আমি আমি করে কিছু হয় না’, শুভেন্দুকে পালটা ফিরহাদ
শুভেন্দুকে নিয়ে এত মাথাব্য়থা কেন তৃণমূলের? বিজেপির কী লাভ?
বছর ঘুরলেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তৃণমূলের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্ক থিতু না হয়ে যদি এমনটাই চলতে থাকে, তাহলে একুশের লড়াই কঠিন হতে পারে মমতা বাহিনীর জন্য়। একাধিক আসনে শুভেন্দুর যে দাপট রয়েছে, তাতে তাঁর সঙ্গে দলের দূরত্ব না ঘুচলে নয়া চ্য়ালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তৃণমূলকে। পূর্ব মেদিনীপুরের মতো রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় শুভেন্দুর বিকল্প খোঁজাও কঠিন হবে শাসকদলের জন্য়।
রাজনৈতিক মহলের ব্য়াখ্য়া, অধিকারী পরিবারের বাইরের কেউ সেখানে গিয়ে শুভেন্দুর ক্য়ারিশমাকে চ্য়ালেঞ্জ জানাতে পারবেন না। শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী ৩ বারের সাংসদ। তাঁর অন্য় দুই পুত্র দিব্য়েন্দু তমলুকের সাংসদ, সৌমেন্দু কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্য়ান। বিভিন্ন কমিটি ও কর্মী ইউনিয়ের মাথাতেও রয়েছে অধিকারী পরিবার।
শুভেন্দুর সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব জোরালো হলে, আখেরে লাভ হতে পারে বিজেপিরই। পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের জয়রথের চাকা আটকে সেখানে পদ্মফুল ফোটাতে বাড়তি অক্সিজেন পাবে গেরুয়াবাহিনী।
অন্য়দিকে, মালদা, মুর্শিদাবাদেও শুভেন্দু-হীন তৃণমূল বিপাকে পড়তে পারে। সেখানেও অ্য়াডভান্টেজ পেয়ে যেতে পারে পদ্মশিবির। বলে রাখা দরকার, নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর বক্তব্য়ের পরই তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ঘোচাতে তৎপর হয়েছে ঘাসফুল শিবির। সে কারণেই সম্প্রতি শুভেন্দুর বাড়িতে হানা দেন তৃণমূলের ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর। যদিও শুভেন্দু-পিকে সাক্ষাৎ হয়নি। এখন দেখার, শুভেন্দু কোন পথে চলেন, যা একুশের ভোটের আগে অত্য়ন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে বলেই ব্য়াখ্য়া রাজনৈতিক মহলের।
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন