আন্তর্জাতিক মণ্ডপে কলকাতার দুর্গাপুজো হচ্ছে। খুব হইচই হচ্ছে। আহ্লাদ হচ্ছে। খবরে খবরে ঢাক বাজছে। ঘর-বাহির, চায়ের পেয়ালা এবং ফেসবুকের দেওয়াল এতেই সরগরম। আচ্ছা, জানেন কি কারা এই পুজোর উদ্যোক্তা। নাহ জানেন না, তা ছাড়া এমন অসময়ে দুর্গাপুজো, এখন তো শীত কনকনে, পুরো পিকনিক মুড! শুনুন তা হলে এই পুজোর উদ্যোক্তা যে-সে কেউ নয়-- ইউনেস্কো। এবার নিশ্চয়ই রহস্যের রসে পৌঁছে গিয়েছেন। বুঝতে পেরে গিয়েছেন, ইউনেস্কো কলকাতার পুজোকে হেরিটেজের যে তকমা দিয়েছে, আমরা সেই কথাই বলছি। ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার। তার পর থেকেই স্বাভাবিক ভাবে পুজো উদ্যোক্তারা থেকে সংশ্লিষ্ট শিল্পীকুল হেরিটেজ-গর্বে ভাসছে। এবং সেটাই যে স্বাভাবিক! বাঙালির গর্ব করার মতো বেশি কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ আছেন বটে এক।
আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির মহা-বাজারে বাঙালি এই রবিঠাকুরের পিঠে চেপেই বোধ হয় প্রথম প্রবেশ করেছিল। সে কবেকার ঘটনা। তার পর, আরও টুকটাক কিছু হয়েছে আমাদের আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় গর্ব করার মতো। কিন্তু বড় কিছু-র তো প্রয়োজন, না হলে ঝড়ে কী করে নিজেদের ওড়ার হাত থেকে ঠেকিয়ে রাখব! তা ছাড়া এত কোটি বাঙালি তো একটা রবির স্তম্ভ ধরে বাঁচতেও পারবে না। তাই, স্বস্তি জাগিয়ে কলকাতার দুর্গাপুজো নামে একটি গর্ব-স্তম্ভ হল নতুন, সৌজন্যে--ওই ইউনেস্কো। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, কলকাতার দুর্গাপুজো কেন, বাংলার দুর্গাপুজো নয় কেন? জবাব সহজ, তিলোত্তমার দুর্গোৎসব ঐতিহ্য এবং আধুনিকতায় কার্যত মিনার ছুঁয়ে ফেলেছে।
গোটা শহরের শরীর বুনে পুজোর বনিয়াদ তৈরি হচ্ছে ইদানিং, এতে নিত্যযাত্রীদের নামাবলির মতো শরীরে যন্ত্রণা দেখা যাচ্ছে, রোগীদের জ্যামে আটকে যায়-যায় অবস্থা হলেও, যে অপরূপ শোভা রচিত হচ্ছে কলকাতার, তা দেখে বিদেশিরা মূর্ছা যাচ্ছেন এদিক-ওদিক। সিটি অফ জয়ের দুর্গাপুজো হাঁকিয়ে একের পর এক মারছে ছক্কা। সারা রাজ্যের মুকুটে কহিনুর হয়ে ইউনেস্কো পর্যন্ত ঝলকানি ছুড়ে দিয়েছে তাই কলকাতার দুর্গা। সম্ভবত এই আন্তর্জাতিক তকমাপ্রাপ্তি তার, সে কারণেই।
পুজোর কলকাতাকে নিয়ে যাঁরা উন্নাসিক, যাঁরা পুজো এলেই বাইরে ছোটেন, সিমলা গিয়ে নিশ্চিন্তি পান, তাঁরা বোধ হয় এবার তিলোত্তমার দুর্গাপুজোর দিকে চশমা-ভরা দু'চোখ তুলবেন। জ্যামজট পেরিয়ে তাদের দৃষ্টি নিশ্চয় কার্পণ্যশূন্য কারুকাজে গিয়ে ঠেকবে। তা ছাড়া, এই ভাবে পুরনো নগরীর পুজাবেদিতে কোভিডকালের হতাশার ঘুরঘুট্টির মধ্যে আলোর একটি দ্বীপও জ্বেলে দিয়েছে যেন ওই সংস্থাটি। যখন বহু শিল্পীর কাছে দুর্গার ডিম্বাকৃতি মুখটা সিদ্ধ ডিমের স্বপ্ন হয়ে উঠেছে, দেবীর চোখের দুই মণি কালোজাম জাতীয় মিষ্টির ইশারা-- সেই কারণেও এই তকমাটি অতি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
ইউনেস্কোর নয়া দিল্লির ডিরেক্টর এরিক ফল্ট বলেওছেন, স্থানীয় মানুষকে এই পুজো উদযাপনে এই তকমা আরও উৎসাহিত করবে। উৎসাহিত হবেন এর সঙ্গে যুক্ত নানা ধরনের শিল্পী, সংগঠক এবং অবশ্যই দর্শক-পর্যটকরা। এখানে বলে নিতে হবে, ২০১৬ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুজো কার্নিভ্যাল করছেন। রেড রোডে কলকাতা এবং আশপাশের জেলার নামি পুজোর চলমান প্রদর্শনী দেখে অনেকে তারিফ করেছেন। এইটি আন্তর্জাতিক নজরও টেনেছে। মুখ্যমন্ত্রী ইউনেস্কোর তকমায় খুশি হয়ে বৃহস্পতিবার বলেছেন, 'এই অর্জনের জন্য আমি গর্বিত।' তা ছাড়া রাজনৈতিক ভাবেও কলকাতার দুর্গাপুজোকে ইনট্যানজিবল হেরিজেটের ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি মুখ্যমন্ত্রীর অস্ত্র নিশ্চয়ই। কারণ, দুর্গাপুজোয় বাধা তৈরি করছে রাজ্য সরকার, বিধানসভা ভোটে এই অভিযোগ তুলে লাগাতার প্রচার করে গিয়েছিল বিজেপি। কলকাতার দুর্গাপুজো যে তালিকায় ঢুকেছে ইউনেস্কোর, তার পুরো নাম-- ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি। এটি ঠিক কী, তা নিয়ে একটু চর্চা করা যেতে পারে।
ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি
ইনট্যানজিবল (Intangible) মানে যা স্পর্শের অতীত। অর্থাৎ যার কোনও স্পর্শযোগ্য চেহারা নেই। যেমন ধরা যাক মন, মেধা, প্রতিভা ইত্যাদি। যার শুধু প্রকাশ দেখা যায়। কোনও উৎসব, কোনও রীতি কিংবা লোককথা, সঙ্গীত কিংবা খাদ্য সংস্কৃতি-- এ সবও ঠিক স্পর্শ করে দেখা যায় না, অনুভব উৎযাপন বা প্রকাশ করে তুলতে হয়। পৃথিবী জোড়া ছড়িয়ে থাকা এমন হাজারো মণিমুক্ত থেকেই ইউনেস্কো তাদের ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকা বানায়, বাড়ায়ও। অনন্য সাধারণ ঐহিত্যের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই এই কাজটি তারা করে থাকে। কারণ, তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এ সব হল হিউম্যান ট্রেজার-- মানব-ঐশ্বর্য। এ ছাড়াও রয়েছে ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ-এর তালিকা। মানে কোনও পুরোন মূর্তি কিংবা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, যা গোদা ভাবে স্পর্শযোগ্য, তাকে ফেলা হয় এর মধ্যে। ইউনেস্কোর তকমা-ধারী এমন ট্যানজিবল হেরিটেজ সারা পৃথিবীতে রয়েছে বিপুল।
'ইনট্যানজিবল' তালিকা
ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি তালিকায় এখন ৪৯২টি এন্ট্রি রয়েছে। ইউনেস্কো জানাচ্ছে, এর মধ্যে ১৩টি ভারতের। কলকাতার দুর্গাপূজা ঢুকল এ বার, এ ছাড়া এ দেশের যা রয়েছে ওই তালিকায়, সেগুলি একে একে বলি। কুম্ভমেলা (তালিকাভুক্ত ২০১৭ সালে), নওরোজ (২০১৬), পঞ্জাবের জান্দিয়ালা গুরু-র তামা-পিতলের বাসন নির্মাণ সংস্কৃতি (২০১৪), মণিপুরের সংকীর্তন (২০১৩), লাদাখের বৌদ্ধ মন্ত্র (২০১২), বাংলার ছৌ-নাচ, রাজস্থানের কালবেলিয়া নাচ, কেরলের মুদিয়েট্টু ( তিনটিই তালিকাভুক্ত ২০১০-এ), গাড়োয়ালের রাম্মান উৎসব (২০০৯), কুটিয়াট্টম সংস্কৃত নাটক, রামলীলা এবং বৈদিক মন্ত্র (২০০৮)।
আরও পড়ুন মেয়েদের বিয়ের বয়স-বৃদ্ধি, আদৌ কিছু লাভ কি হবে?
এই বছর পৃথিবীর নিরিখে এই তালিকায় আরও এসেছে: আরব লিখনশৈলী, উজবেকিস্তানের বকশি শিল্প, কঙ্গোর রুম্বা নাচ, ফ্যালকনরি শিকার সংস্কৃতি, ডেনমার্কের ইনুইট ড্রাম-নৃত্য এবং ইটালিয়ান ট্রাফল হান্টিং (ট্রাফল এক ধরনের ছত্রাক, তার খোঁজ সংক্রান্ত যে প্রথা)। তবে, শেষে বলি, কলকাতার দুর্গাপূজা সারা পৃথিবীর এত ইনট্যানজিবল হেরিটেজের মধ্যে একটা, এটা না ভেবে, চাল-ফাটা বন্যা-বিধ্বস্ত গরিব বাঙালিঘরের স্মার্ট টিভি মনে করলে, আনন্দের রেশ থাকবে অনেক দিন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন