‘পবিত্র’ কালি বেঁই বা কালি নদীর জল খাওয়ার পরে হাসপাতালে ভর্তি পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান। এই ঘটনায় সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু সিনেমাটা মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকের। দুটি ঘটনা দুই স্রোতে বইলেও এই মনে পড়ায় কোনও বাধা হচ্ছে না। সত্যজিৎ ওই ছবিটা বানিয়েছিলেন ইবসেনের নাটক অ্যান এনিমি অফ দ্য পিপল-এর অবলম্বনে। ছবিতে দেখানো হয়েছিল, জল দূষিত হয়ে পড়েছে চণ্ডীপুর নামে একটি জায়গার। তা সেই চণ্ডীপুরের কেন্দ্রস্থলে যে মন্দির রয়েছে, গাদা গাদা ভক্ত সেই মন্দিরের চরণামৃত খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সত্য উৎঘাটন করেছেন ডাক্তার গুপ্ত। তাতে তাঁকেই গণশত্রু দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা, এই সিনেমায় মন্দিরের অবাঙালি মালিক ভার্গব এক দিন ডাক্তার গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তখন অনেক কথা বলেন চরণামৃতকে নির্দোষ প্রমাণে। একটা কথা কানে লেগে রয়েছে, তিনি একটি বোতল ভরা চরণামৃত দেখিয়ে বলছেন, দিস চরণামৃত অ্যান্ড অল চরণামৃত ইজ ফ্রি ফ্রম জার্ম।
এখন, পঞ্জাবের সুলতানপুর লোধির ওই কালি নদীতে ডুব দিয়ে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন গুরু নানক। নদীটিকে মনে করা হয় পবিত্র, ফলে চরণামৃতের সামিল। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সেই বিশ্বাসে ভর করে কিনা জানা নেই (নাকি এতটাই ভরসা ছিল জলের পরিষ্ককরণ প্রকল্পের সাফল্যে) এক গ্লাস কালি-জল ঢকঢকিয়ে খেয়ে ফেললেন। তাতে কী বার্তা গেল? তাঁর অসুস্থতার চেয়েও বার্তাটা গুরুত্বপূর্ণ, বার্তাটা হল— আমি খাচ্ছি এই জল, আপনারাও খেয়ে নিন। এই জল পানের যোগ্য। এটা যে খুবই মারাত্মক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াল জনস্বাস্থ্যে, খুবই উদ্বেগজনক— তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই প্রকৃতিবিদদের।
কালি-কথা
এই জলাঞ্চল যাকে কালি নদী বলা হয়ে থাকে, তার দৈর্ঘ ১৬৫ কিলোমিটার। হোসিয়ারপুর থেকে শুরু হয়ে বিপাশা ও শতদ্রুর সংযোগে মিশেছে কাপুরথালায়। এই পথে চারটি জেলা পেরিয়েছে কালি। এর তিরবর্তী অঞ্চলে রয়েছে ৮০টি গ্রাম, আধ ডজন ছোট এবং বড় টাউন। বর্জ্য জল, নানা ছোটবড় শহরের, শিল্পেরও বিপুল দূষিত তরল নদীর জলে এসে পড়ে এর বারোটা বাজিয়েছে। নানা ড্রেনের সংযোগে এটি ক্রমে একটি বড়সড় ড্রেনে পরিণত হয়েছিল বললে ভুল হবে না। জলও কালো হয়ে গিয়েছিল। নদীর জল চলাচল ভুলে গিয়েছিল, জলের উপর ছিল লতাগুল্ম ঘন কচুরিপানার আস্তরণ। তার পর শুরু হল এটি সংস্কারের কাজ। আস্তে আস্তে নদীর রূপ ফিরে পেল কালি, এখন তাকে দেখলে সত্যিই ভাল লাগে, মনও ভরে, পুরনো চেহারাটির সঙ্গে তুলনা করলে অবাক হতে হয়। কিন্তু জল খাওয়া যাবে না, অসম্ভব-- জল পানের পর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং, কটাক্ষ অনেকের।
আরও পড়ুন Explained: মমতার হাতিয়ার ‘মুড়ি’, জানুন বাঙালির প্রিয় খাদ্যের খুঁটিনাটি
কী কারণে এই জল পান?
কালি নদী পরিষ্ককরণ প্রকল্পের ২২ বছর পূর্তির উপলক্ষ ছিল সে দিন। প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের ১৫ জুলাই। প্রাথমিক বছরগুলিতে হইহই করে এর অগ্রগতি ঘটলেও, তার পর গতি রীতিমতো মন্দ হয়ে ওঠে। তবে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মান কালী নদীর যে জল খেয়েছেন, তা ২০০০ সালের আগের নদীজলের চেয়ে অনেক ভাল। আগেই বলেছি, এখানে চান করার পর গুরু নানকের আলোকপ্রাপ্তি ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়। বোন বেবে নানকির সঙ্গে গুরু নানক সুলতানপুর লোধিতে থাকতেন তখন। স্নান করতে যেতেন কালি নদীতে। বলা হয়, এক দিন নাকি সেখানে ডুব দিয়ে উধাও হয়ে যান গুরু। তিন দিনে ওঠেন জল থেকে। তার পর প্রথম যেটা বলেছিলেন, সেইটা হল, শিখ ধর্মের ‘মূল মন্ত্র’।
পরিষ্করণ প্রকল্পের আরও কথা
এই প্রকল্পটি চালু করেন প্রকৃতিবিদ বাবা বলবীর সিং সিচেওয়াল, এখন যিনি আপ-এর রাজ্যসভার সদস্য। যিনি পঞ্জাব দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের প্রাক্তন সদস্যও। নিজের কিছু অনুসারীকে নিয়ে কোনও সরকারি সাহায্য ছাড়াই তিনি এই কালি নদীকে পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। সাত বছর ধরে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করে কালি নদীর হাল অনেকটাই বদলে দেন। ২০০৬-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম সেখানে গিয়েছিলেন, এবং বলবীরদের কাজের প্রশংসাও করেছিলেন। কংগ্রেস সরকারের তরফে তার পর ঘোষণা করা হয়েছিল, যাতে নোংরা জল নদীতে এসে না পড়ে, সেই প্রকল্পটি তারা হাতে নেবে। সরকার ৭৩টি গ্রামকে চিহ্নিত করে, যেগুলির বর্জ্য জল এসে পড়ছে কালি নদীতে। প্রতি গ্রামে একটি বড় পুকুরের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়, যে পুকুরের জায়গা দেবে পঞ্চায়েত, যেখানে নোংরা জল এসে পড়বে, তার পর সেই জল নির্দোষ করে তোলা হবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে, এবং তা ব্যবহার করা হবে চাষের কাজে।
আরও পড়ুন Explained: রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, জানুন তাঁর উত্তরণের কাহিনি
এখন কী অবস্থা
মান জানতেন কি না জানা নেই যে, এখনও ৩০ থেকে ৪০টি গ্রাম এবং টাউনের অবৈধ কলোনির বর্জ্য জল এসে পড়ছে এই কালি নদীতে। ফলে কালি নদীর জল এখনও দূষিত। প্রতি বছর আমাদের সামনে এসে হাজির হয় সেই ছবি, যে সবে দেখা যায় গাদা গাদা মাছের দেহ ভাসছে এই নদীর জলে। মাছ যে জলে মরে যাচ্ছে মানুষ সেই জল খেলে মরতেও পারে, আবার একটুর জন্য বাঁচতেও পারে, বা হাসপাতালে গিয়ে ধুঁকতেও পারে, তাই না!