বুধবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুম্বইয়ে একটি বোমা ফাটিয়েছেন। ইউপিএ-কে আগামী দিনে নেতৃত্ব কি তিনি দেবেন? এমন প্রশ্নে মমতা বলে দিয়েছেন, কিসের ইউপিএ, এখন আর ইউপিএ নেই। মমতার সাফ বুঝিয়ে দেওয়া, বিজেপিকে চ্যালেঞ্জে কংগ্রেস আর নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় মোটেই নেই। সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলিকে এক হয়ে যে লড়াইয়ের ডাক, তাতে যে নেত্রী তিনিই, তা আর বলে দিতে হয় না। তবে জিতলে প্রধানমন্ত্রীর তখতে কে বসবেন, সেইটি আপাতত আলগোছে পাশে সরিয়ে রাখছেন। মমতার এই ইউপিএ-উবাচে, কংগ্রেস চটেছে, কিন্তু তাতে মমতার কি! মমতা তো গোয়া থেকে হিমাচল-- সর্বত্র কংগ্রেসকে চটাচ্ছেন, তার পারদ একটু বাড়বে, মমতার বৃদ্ধি বৈকি এতে ক্ষতি কিছু নেই। আপাতত, ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী থাকা মমতার এই মন্তব্যের সূত্রে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বিজেপি বিরোধী জোট, ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্টের উত্থান-পতনে নজর দিয়েছে।
ইউপিএ-র জন্ম
২০০৪ সালের ভোটে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র পরাজয়ই ইউপিএ-র জন্মের সূচনা ঘটিয়েছিল। বিজেপির চেয়ে কংগ্রেসের আসন বেশি ছিল মাত্র সাতটি, আসনসংখ্যা-- ১৪৫। কংগ্রেস সবচেয়ে বড় দল হয়েও, সরকার গঠনের জন্য তাদের ভালমাত্রায় সঙ্গীর দরকার। বিজেপি সাম্প্রদায়িক, ফলে জোট বাঁধো, বিরোধী মহলে অনেকেই এ কথা বলছিলেন। মিলে সুর মেরা তুমহারা হোক না, ভাবছিলেন তাঁরা। ভাবা এক, কাজের কাজটি করা আর এক। পোড়-খাওয়া কমিউনিস্ট নেতা তথা সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হরকিষণ সিং সুরজিৎ এই জোট-বাঁধার কাজে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন। ১৪টি আঞ্চলিক দলকে কংগ্রেসের হাত ধরার জন্য তৈরি করলেন সুরজিৎ। আরজেডি, ডিএমকে, পিএমকে, টিআরএস, জেএমএম, এলজেপি, এমডিএমকে, এআইডিএমকে, এআইএমআইএম, পিডিপি, আইইউএমএল, আরপিআই (এ), আরপিআই (জি) এবং কেসি (জে)। নির্বাচন পরবর্তী এমন জোট! যেন একটা অসাধ্যসাধন হয়ে গেল ভারতীয় রাজনীতিতে। চারটি বাম দল, সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক-- কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা জানাল। কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম বা ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির উপর ভিত্তি করেই তাদের এই সমর্থন। যে কর্মসূচিটি সই হল ২০০৪ সালের মে মাসের ১৭ তারিখ।
শুরুতেই জটিলতা
কংগ্রেসের তরফে জোট-বৈঠকে সমাজবাদী পার্টি এবং আরএলডি-কে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ফলে সুর একটু কাটছিল। কিন্তু দেখা গেল সুরজিৎ আরএলডি-র অজিত সিং এবং সপা-র অমর সিংকে নিয়ে এসেছেন। মানে, বিজেপির বিরুদ্ধে পুরো এক ব্রিগেড, সরকার গঠনের জন্য ফুটছে। বোঝা গেল, খেলা জমে গিয়েছে, দিল্লির দুনিয়ায় এবার জোটশক্তির রাজ।
নাম কী হবে জোটের? স্থির হল-- ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স, সংক্ষেপে ইউপিএ। যদিও এটা প্রথম পছন্দ ছিল না মোটেই। অনেকেই বলেছিলেন ইউনাইটেড সেকুলার অ্যালায়েন্স, অনেকে আবার সওয়াল করলেন নাম হোক-- প্রোগ্রেসিভ সেকুলার অ্যালায়েন্স। তবে, কী করে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেল? সেই কাজটি হয়েছিল তৎকালীন ডিএমকে সুপ্রিমো করুণানিধির ক্ষুরধার যুক্তিতে। ২০০৪ সালের, ১৬ মে-র বৈঠকে করুণানিধি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধিকে (হ্যাঁ, তামিলেই) বলেছিলেন সেকুলার মানে অ-ধর্মীয়, তাই এই নাম দেওয়া ঠিক হবে না, তাই প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স নাম রাখা হোক। সবাই যা মেনে নিয়েছিলেন একবাক্যে।
২২ মে, ২০০৪। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। ইউপিএ সরকারের পথচলা শুরু হল। এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার, আরজেডি মুখিয়া লালুপ্রসাদ যাদব, এলজেপি-র শেষ কথা রামবিলাস পাসোয়ান, জেএমএম ফার্স্ট পার্সন শিবু সোরেন, টিআরএসের সূর্য কে চন্দ্রশেখর রাও, ডিএমকে-র টিআর বালু, দয়ানিধি মারান এবং এ রাজা, পিএমকে প্রধান এল রামাদোসের ছেলে অম্বুমানি সেই দিন শপথ নিয়েছিলেন।
ব্যর্থতার খতিয়ান
প্রথম যে দলটি বেরিয়ে গিয়েছিল ইউপিএ থেকে, তার নাম টিআরএস, ২০০৬ সালের ঘটনা। কেসিআর তখন শ্রমমন্ত্রী এবং তাঁর দলের এ নরেন্দ্র মন্ত্রিসভায়। তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে তাঁরা পদত্যাগ করলেন। ভাইকো-র এমডিএমকে ইউপিএ ছাড়ল ২০০৭ সালে। তাদের অভিযোগ ছিল ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির বেশির ভাগ প্রকল্পেই সরকার ব্যর্থ। এর পর, ইউপিএ সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেল বামেদের থেকে। ২০০৮ সালে। পরমাণু চুক্তির বিরুদ্ধে তখন বামেরা কোমর বেঁধে লড়ছে। এই ইস্যুতে সরকারকে পিছু হটানোর চেষ্টাও চলেছে বেশ কিছু দিন ধরে। কিন্তু মনমোহন সরকার নিজেদের অবস্থান থেকে সরবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল সপাট, তাতেই বামেরা, মানে চার বাম দল, সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক, যারা বাইরে থেকে মনমোহন সরকারকে সমর্থন করছিল, সরে দাঁড়াল। সুরজিতের সহজ এবং সূক্ষ্মতা-গাঁথা যে প্রচেষ্টা ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে, তা তাঁরই দল ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে অস্তাচলে পাঠাল, বলেন অনেকেই।
সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়ল এই বার। যদিও বেঁচে গেল অনাস্থার মুখে। কারণ, মুলায়ম সিং যাদব 'হাত'-এর মাথায় হাত রাখলেন। সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে তরি ভিড়ল। মানে, সেই সমাজবাদী পার্টি, যারা ইউপিএ গঠনের সময় কংগ্রেসের ডাক না পেয়ে অপমানে জর্জরিত ছিল-- ২০০৪ সালেটা তখনও বেশি পুরনো হয়নি, মাত্র চার বছর!
এর পর, ২০০৯ সাল, নিজেদের রাজ্যে নির্বাচনী বাধ্যবাধকতায় ইউপিএ থেকে বেরিয়ে গেল পিডিপি এবং পিএমকে। পিএমকে তামিলনাড়ুতে জোট বাঁধল এআইএডিএমকে-র সঙ্গে, তাদের লড়াই ডিএমকে-কংগ্রেস জোটের বিরুদ্ধে। আবার অন্য দিকে, পিডিপি ইউপিএ ছাড়ল এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে জোট করে জম্মু-কাশ্মীরে সরকার গড়ল।
দ্বিতীয় দফা
২০০৯ সালে, এত ধাক্কার পরেও, কংগ্রেস জিতে গেল। সত্যি, যা অবাক করা ঘটনা, অনেকের কাছেই। কংগ্রেস পেল ২০৬টি আসন। পাঁচ বছর আগের থেকে ভাল অবস্থায়। যারা ছেড়ে গিয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্যে তখন হাতের হাতের বুড়ো আঙুল উত্থিত, উদ্যত, উদ্ধত। যদিও তাদের তখনও দরকার সরকার গঠনের জন্য সংখ্যা, সঙ্গী। হ্যাঁ, সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থনের হাত বাড়ালেন। রেলমন্ত্রক দেওয়া হল তাঁকে। মমতা এর তার আগেও এক বার রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন আবার তিনি এনডিএ-তে। বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় ১৯৯৯ থেকে ২০০০ পর্যন্ত সে দফা।
প্রথম ইউপিএ-র তুলনায় দ্বিতীয় ইউপিএ-তে সঙ্গী অনেক কম কংগ্রেসের। কংগ্রেসের সঙ্গে মাত্র পাঁচ দলের প্রতিনিধি শপথ নিলেন। তৃণমূল, এনসিপি, ডিএমকে, ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ। ইউপিএ-কে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের গাথা তখনও মুখে মুখে। লালুপ্রসাদ যাদব, রামবিলাস পাসোয়ানের মতো নেতার অনুপস্থিতিও চোখে পড়ছিল। বিহারের ভোটে তাদের প্রতি কংগ্রেসের উদাসীনতার ছবিটাও ছিল সামনে। যদিও আরজেডি, বিএসপি এবং এসপি সরকারের দিকে সমর্থনের বাহু বাড়িয়েছিল। লালু ২০১০ সালে সমর্থন প্রত্যাহার করেন, মহিলা সংরক্ষণ বিলের তাঁদের কথায় কান না দেওয়ার অভিযোগে। এআইএমআইএম, ভিসিকে, সিকিম ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট এবং বড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্টের মতো কয়েকটি দল ইউপিএ-তে থাকলেও, মন্ত্রিসভায় তাদের উপস্থিতি ছিল শূন্য।
তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ-তে কর্তৃত্ব দেখিয়েছিলেন রীতিমতো। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলে, দিনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রী হন, কিন্তু ২০১২ সালে রেলভাড়া বৃদ্ধিতে দিনেশকে সরে যেতে বলেন মমতা, মুকুল রায়কে সেই মন্ত্রক দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেসকে মমতার সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও। মার্চ, ২০১২-- ডিএমকে ইউপিএ থেকে সরে গেল। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে। তাঁদের পাঁচ মন্ত্রী গুডবাই জানালেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে এফডিআই-ইস্যুতে তৃণমূল ছাড়ল ইউপিএ-কে। বেরিয়ে এলেন তাদের ছয় মন্ত্রীও ।
কমতে কমতে…
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ৪৪-এ নেমে আসে। তার পর থেকে ইউপিএ বলতে কংগ্রেসের সঙ্গে যাদের মতের মোটামুটি মিল, তাদের বোঝানো হয়ে থাকে। কারণ ইউপিএ-তে যারা আছে বলে ধরা হয়, বহু দিন কোনও তাদের কোনও বৈঠক হয়নি। ডিএমকে, এনসিপি এবং জেএমএমের মতো কয়েকটি দল ছাড়া বাকিদের সঙ্গে সম্পর্কেও কংগ্রেসের টানাপোড়েন রয়েছে। ২০১৯-এর ভোটে কংগ্রেস ফের বড় ধাক্কা খেয়েছে কংগ্রেস। মাত্র ৫২ আসন। ইউপিএ আরও বায়বীয় তার পর। সে দিক থেকে দেখলে মমতা হয়তো ঠিক কথাই বলেছেন। এখন আর ইউপিএ বলে কিছুই নেই।
আরও পড়ুন মেঘ-রাজ্যে কেন কংগ্রেস-পতন, জাতীয় লক্ষ্যে কোথায় তৃণমূলের ঘোড়া?
নতুন একটা জোটের ধুকপুকুনি। যা বিজেপির বিরুদ্ধে রণডঙ্কা বাজাবে। মমতাদের রাজনৈতিক স্বপ্নও তারই মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। সেই সূর্যটি কি তাঁরা আকাশে টাঙাতে পারবেন? নেতৃত্বের ধন্ধ-মূলক যা কিছু সে সব বাদ দিয়ে কি মমতাকে সবাই মেনে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, মারাঠা স্ট্রংম্যান শরদ পাওয়ারই কি হচ্ছেন সেই দলের চাণক্য? শাবানা আজমি- জাভেদ আখতারদের মতো বিদ্বজ্জনরা কি ভূমিকায় থাকবেন? নজর রেখেছে দেশ। কংগ্রেসও নিশ্চয়ই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন