ওমিক্রন-যুগে বুস্টার ডোজের যাত্রা এ দেশে শুরু হবে কবে, সেই জল্পনা চলছে। যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত পৌঁছয়নি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। এখন অনেকেই তির ছুড়ছেন এই বলে যে, পর্যালোচনায় বেশি সময় খরচ করে ফেললে ওমিক্রন এসে অকাজের কাজটি করে চলে যাবে! চোর পালালে বুদ্ধি বাড়বে তখন, তাতে ক্ষতি হয়ে যাবে বিস্তর! অনেকের আবার এমনও ভাবনা-- দুটো ডোজই যথেষ্ট, বুস্টারে আছেটা কি, তা হলে তো কোনও দিন ভ্যাকসিন নেওয়াই শেষ হবে না, কারণ ভ্যারিয়েন্টের পর ভ্যারিয়েন্ট তো আসতেই থাকবে করোনার! কারওর আবার শ্লেষ-- আরে বাবা দুটো দেওয়ার পথই শেষ হচ্ছে না-- দুই না গুনে তিন গুনবেন কী করে! হ্যাঁ মুনি নানা থাকলে, নানা মত তো থাকবেই। কথাসাগরও তৈরি হবে। আমরা সে সবে কান না দিয়ে, বুস্টার ডোজে কড়া নজর দিতে চাই। বুস্টারে বিশেষত্বটা কী, একটু দেখে নিতে চাই।
বুস্টার ডোজে ভারতের অবস্থান কী?
ইন্ডিয়ান টেকনিকাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ অন ইমিউনাইজেশন বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সংক্রান্ত পরমর্শদাতা গ্রুপ। সংক্ষেপে এনটিএজিআই (NTAGI)। নিময় অনুযায়ী এঁদেরই স্থির করতে হবে এ দেশে কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার জোড দেওয়া হবে কি না? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানতে পেরেছে যে, এই গ্রুপের সদস্যদের বুস্টার দেওয়া নিয়ে কোনও মতপার্থক্য নেই। তবে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে শীর্ষ সরকারি সূত্রে এও খবর এসেছে, এই পরামর্শদাতা গ্রুপটি বুস্টারের প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত বিচার-বিবেচনাপর্বটি এখনও শেষ করে ওঠেনি। জানা গিয়েছে, দুটি ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর যদি কেউ বুস্টার নেন, তাঁর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে-- মনে করছে এনটিএজিআই।
বুস্টার ডোজ কী?
কোনও কোভিড ভ্যাকসিনের ডোজ একটা, কোনওটার আবার দুটো। দুই ডোজের ভ্যাকসিনের সংখ্যাই বেশি। এখন মূল ডোজের পর ভ্যাকসিনের যে ডোজ দেওয়া হয়ে থাকে, আরও সুরক্ষার স্বার্থে, তাকে বুস্টার ডোজ বলে। রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ ডা. বিনিতা বল বলছেন, নানা কিছুর উপর নির্ভর করে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর প্রতিরোধ শক্তি কত দিন বজায় থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় অ্যান্টিবডিগুলি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এমনকি টি-সেল মেমরিও চলে যেতে পারে কিছু মাস বা বছর পর। এখানেই বুস্টার ডোজের গুরুত্ব। এই ভাবনা বিজ্ঞানীদের অনেকেরই। বুস্টার ডোজের পক্ষে তাঁরা জোর সওয়াল চালাচ্ছেন। আমেরিকা সহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে জোর কদমে বুস্টার চালুও হয়ে গিয়েছে। এমনিতে বেশ কিছু ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। স্মলপক্সের ভ্যাকসিনের বুস্টার যেমন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। টিটেনাস টক্সয়েডের বুস্টার ডোজ প্রাপ্তবয়স্কদের দিতে বলা হচ্ছে। অন্তসঃত্ত্বা মহিলাদেরও তা বলা হচ্ছে।
ভ্যাকসিনের প্রতিরোধশক্তি হ্রাসে কী গবেষণা?
সেপ্টেম্বর মাসে, আইসিএমআরের ভুবনেশ্বর রিজিওনাল মেডিক্যাল সেন্টার রিসার্চ সেন্টারের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে চার মাসে কোভিড ভ্যাকসিনের অ্যান্টিবডি কমে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। প্রতিষেধকের দুটি ডোজ নেওয়ার পরই এটা হতে দেখা গিয়েছে।
এমআরএনএ ভ্যাকসিনের রোগপ্রতিরোধ নিয়ে আরেকটি গবেষণা প্রকাশ পায় সায়েন্স জার্নালে, এ বছরের শুরুতে। সেখানেও বলা হয়েছে, অ্যান্টিবডির লেভেল কমে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে। কিন্তু মেমোরি বি-সেল এবং টি-সেল রেসপন্স বজায় থাকছে।
বুস্টার ডোজ নিয়ে কী তথ্য হাতে?
বায়ো-এনটেক এবং ফাইজার বলছে, তাদের ভ্যাকসিনের (বুস্টার সহ) তিন দফা কোর্স ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে রুখে দিতে পারে। যা নাকি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে তারা জানতে পেরেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের বিজ্ঞানীরাও বুস্টার ডোজের পক্ষে মত জানিয়েছেন। bioRxiv নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত হয় এই গবেষণাপত্রটি।
বুস্টার ডোজের পক্ষে কেন এত সওয়াল?
আইসিএমআরের ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্সের সদস্য সঞ্জয় পুজারী বলছেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গণহারে ভাইরাসের সংক্রমণ প্রবল হয়ে উঠলে, এই বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা রীতিমতো। সঞ্জয়ের মত, ইজরায়েলে সংক্রমণের সংখ্যা কমে গিয়েছে বুস্টার ডোজের জেরে। বিজ্ঞানী ভি এস চৌহান বলছেন, ভারতে ভ্যাকসিনের বাড়তি স্টক নেই। ফলে নীতি নির্ধারকদের এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, স্থির করতে হবে কবে বুস্টার ডোজ দেওয়ার কাজ শুরু করা যাবে। অন্তত যাঁরা ছ'মাস হল ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাঁদের দেওয়া দরকার এই ডোজ। যাঁরা স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের নেওয়া বেশি দরকার।
বিশেষজ্ঞদের অনেকের আবার মত, করোনার সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন বুস্টার ডোজ কিন্তু তেমন কার্যকরী হবে না। বিশেষ করে যে অঞ্চলে করোনার প্রতিপত্তি প্রবল, সেইখানে। তাই প্রাথমিক প্রতিষেধকের কোর্স শেষ করা উচিত আগে। বুস্টারের ফলে প্রথমিক প্রতিষেধকের প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ণ হলে মুশকিল! ভ্যাকসিনের মূল দুটি ডোজ নেওয়া থাকলে রোগ প্রতিরোধে অনেকটাই শক্তি মিলবে। মৃত্যু ঠেকানো যাবে। তাই আগে সেই কাজটা শেষ করা উচিত।
কেন বিভিন্ন দেশ বুস্টারের পথে হাঁটছে?
বেশ কয়েকটি দেশ কিন্তু মনে করছে বুস্টার দিতে হবে। না হলে চলবে না। ফলে তারা নেমে পড়েছে বুস্টার ময়দানে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি-র তরফে কিছু দিন আগেই সমস্ত ভ্যাকসিনেই বুস্টার ডোজে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তারা বলেছে, যাঁরা ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ডোজ নিয়েছেন অন্তত ছ'মাস, তাঁরা বুস্টার নিতে পারবেন। ইউরোপীয় স্বাস্থ্য সংস্থাও একই পথে হাঁটছে। অনেক দেশই এক বছর ধরে চলছে প্রতিষেধক অভিযান। প্রথমিক প্রতিষেধক দেওয়ার কাজটি তারা অনেকেই গুটিয়ে এনেছে অনেকটা। ফলে বুস্টার ডোজে তারা জোর দিচ্ছে এখন। এই ওমিক্রন-সময়ে তৃতীয় জোজকে অবলম্বন করতে চাইছে।
আরও পড়ুন বেলা বাড়লে জোর বাড়ছে ভ্যাকসিনের, গল্প হলেও সত্যি! নেপথ্যে কী?
বুস্টার ডোজে কী বলছে WHO?
অক্টোবরে বুস্টার বিবৃতি দেয় হু। তাদের মত, বিভিন্ন প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে বুস্টারের কার্যকারিতা বিভিন্ন রকম। সব জনগোষ্ঠীতেও এর সমান প্রভাব নয়। বুস্টার ডোজ জরুরি কতটা, এর কার্যকারিতা কেমন, তা বোঝার মতো যথেষ্ট তথ্য হাতে নেই। এবং বুস্টারের চেয়ে প্রথমিক প্রতিষেধক দেওয়ার কাজেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
গতিপ্রকৃতি যে দিকে, মনে হচ্ছে ভারতে তাড়াতাড়িই চালু হয়ে যাবে বুস্টার ডোজ। তবে ওমিক্রন রুখতে এই ডোজ কতটা সক্ষম হবে, সেই তথ্যটা বিস্তারিত জানাটা সবিশেষ প্রয়োজন এখন। মানে, বুস্টারও নিলেন আবার ওমিক্রনও হল, তাতে চিন্তা বাড়বে! বুস্টার তাতে হাস্যকর হয়ে উঠবে বৈকি! বুস্টারের স্টার খসে পড়ে যাবে মাটিতে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন