ক্রিটেশাস মাস এক্সটিঙ্কশন। মানে বুঝতে পারলেন? যদি বুঝে থাকেন, তা হলে তো দারুণ ব্যাপার! আর না বুঝে থাকলে, এটি নিয়ে দু'-একটি কথা বলে নিতে হবে। পৃথিবীতে কিলবিল-করা সরীসৃপদের নিয়ে যে যুগ এসেছিল, ২৫২ বিলিয়ন বছর আগে, চলেছিল ১৮৬ মিলিয়ন বছর ধরে। মানে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে পর্যন্ত। সেই যুগটি ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই সময়ে পৃথ্বীবক্ষে ঘুরে বেরিয়েছেন মহামান্য ডাইনোসোররা। বহুল সরীসৃপের উপস্থিতির ফলে মেসোজোইক-কে সরীসৃপ যুগও বলা হয়ে থাকে তাই, চলতি কথায়। এই যুগ আবার তিন ভাগে বিভক্ত। ট্রিয়াসিক, জুরাসিক এবং ক্রিটেশাস। এখন এই ক্রিটেশাস যুগে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল মহাবিনাশ। আকাশ থেকে ছুটে নেমে এসেছিল গাদা গাদা গ্রহাণু। গণহারে পৃথিবীর সরীসৃপদের বিনাশ ঘটেছিল তাতে। মাটিতে-ঘোরা ডাইনোসর তো বটেই, ৭০ শতাংশের বেশি প্রাণীই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তখন। ক্রিটেশাস মাস এক্সটিঙ্কশন বলে এই মহামৃত্যুকে। বাংলায় ক্রিটেশাস মহাবিনাশ বলা যেতে পারে।
যা হোক, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রিটেশাস যুগের আগেও আরও চারটি মাস এক্সটিঙ্কশন এসেছিল আমাদের এই পৃথিবীতে। মানে, গণহারে প্রাণীমৃত্যু ঘটেছিল আরও চার বার। কয়েক দিন আগে এ নিয়েই একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে। সেখানে বলা হয়েছে, পেলেয়োজোইক যুগের অর্ডোভিসিয়ান কালে একবার মহাপ্রলয় এসেছিল পৃথিবীতে। যা কিনা ৪৪৫ মিলিয়ন বছর আগেকার ঘটনা। সে ছিল আরও ভয়ঙ্কর প্রলয়নাচন, পৃথিবীতে ঘুরেবর্তে থাকা প্রাণীকুলের ৮৫ শতাংশের বেশিই শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন।
৩৭৫ মিলিয়ন বছর আগে ডেভোনিয়ান কালে এসেছিল আরও একটি, তখন ৭৫ শতাংশ প্রাণীর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল। তারও বেশ কিছুটা পরে, পার্মিয়ান সময়েও এসেছিল সেই মহামৃত্যুর দূত। ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে সে ঘটনা। এখানে বলতেই হচ্ছে যে, মিলিয়ন যেন কোনও ব্যাপারই নয় এই সময়কালের হিসেবে, এক মিলিয়ন মানে ১০ লক্ষ, ফলে মিলিয়নের হিসেবের সঙ্গে ১০ গুণ করে করে দেখলে যে বিশাল সময়সংখ্যা হয়, তা মস্তিষ্কে গোঁগোঁ শব্দ তুলতে পারে, নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হতে পরে, সকল অহঙ্কার চোখের জলে ডুবে যেতে পারে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ২৫০ বছর আগে পার্মিয়ান কালে যে মৃত্যুর মহাকাব্য রচনা হয়েছিল পৃথিবীতে, তখন ৯৫ শতাংশই প্রাণীই ভ্যানিস হয়ে যায়। এর পর ২০০ মিলিয়ন বছর আগে পৌঁছলে আরও আর বার শ্রীপ্রলয় বা শ্রীবিনাশের দর্শন মিলবে। ট্রিয়াসিক যুগে, যে যুগের কথা লেখার শুরুতেই বলেছি, তখন, প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে হে নটরাজ…. ৮০ শতাংশ প্রাণীই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এই বসুন্ধরার। কিছু ডাইনোসরও ছিল তার মধ্যে।
কিছু গবেষকের মত, এখন আমরা ষষ্ঠ গণহারে প্রাণীমৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলেছি। এর কারণ, মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর উষ্ণতাবৃদ্ধি। মাস এক্সটিঙ্কশনের নানা তত্ত্ব রয়েছে, হাজারো কারণ রয়েছে। একটির সঙ্গে অন্য আর একটি মহাবিনাশের মিল-অমিলও রয়েছে। বিজ্ঞানী-ভূতত্ত্ববিদরা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই সব ছেনে দেখছেন। অনুপুঙ্খ কারণগুলি বার করার চেষ্টা করছেন। হয়েওছে আনেকটা।
জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রের মূল লেখকদের একজন জুনলি লু বলছেন, 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা উষ্ণায়নে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপ বেড়ে যায়, এর ফলে অক্সিজেনের অভাব তৈরি হয়, সামুদ্রিক প্রাণিদের উপর তার তীব্র প্রভাব পড়ে। গোটা বাস্তুতন্ত্র নড়বড়ে হয়ে যায়।' এইটুকু শুনেই ত্রাহি মধুসূদন করবেন না, লু-র গুগলি বাকি রয়েছে। তিনি বলছেন, 'শীতল জলবায়ুর এলাকাতেও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, মাস এক্সটিঙ্কশনের কারণও হয়ে উঠতে পারে তা।' জুনলি আমেরিকার সিরাকিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, বিশ্লেষণে তাঁর কোনও খুঁত নেই। গবেষক দলটি পাথরের আয়োডিনের ঘনত্ব খতিয়ে দেখে অক্সিজেনের হালহকিকতটা বুঝতে চেষ্টা করেছে। যখন মাস এক্সটিঙ্কশন হয়েছিল সেই সময়ের পাথর বিশ্লেষণ করে তাঁরা বলছেন, জলবায়ুর শীতলতা অর্ডোভিসিয়ান যুগের শেষ ধাপের মহামৃত্যুর জন্য দায়ী।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই সময় গভীর সমুদ্রে অক্সিজেন তীব্র অভাব বা অ্যানক্সিয়া তৈরি হয়েছিল, তাতেই জীববৈচিত্রে বিঘ্ন ঘটেছিল প্রথমে, যা ডেকে এনেছিল শেষের দিনটা। ওই গবেষণাপত্রের আরেক লেখক আলেকজান্দ্রে পোল বলেছেন, 'অক্সিজেনের অভাব বা অ্যানক্সিয়া তৈরি হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা উষ্ণায়নের ফলে, এটাই সাধারণ ধারণা আমাদের। কিন্তু সেই প্রাণী-মহামৃত্যুতে এমনটা ঠিক ঘটেনি।' তাঁরা ক্লাইমেট কুলিংয়ের নববিশ্লেষণ করেছেন ওই গবেষণাপত্রে। এই কুলিংয়ের ফলে খাদ্যশৃঙ্খলের তছনছ হয়েছিল যে ভাবে, তাও অর্ডোভিসিয়ান মাস এক্সটিঙ্কশনের একটা বড় কারণ হয়ে ওঠে, বলছেন তাঁরা।
এখন অবশ্য গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মহাগ্রাস। কিন্তু দুই ক্ষেত্রে নিট ফল একই হতে পারে। অক্সিজেনের অভাব, তাতে জীবের মহাসর্বনাশ। এই যে করোনা এসে এত মানুষকে গপ করে গিলে নিল, এর পিছনে কী তত্ত্ব, সে ব্যাপারেও চুলচেরা ভাবতে হচ্ছে বিজ্ঞানীদের। কত দিন আর এই সাধের পৃথিবীর প্রাণটা থাকছে, এই প্রশ্নটা বড় হতে হতে ফুটবল হয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবীই নানা পদক্ষেপ করছে, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। অনেক। এখনও আছে সময়… সত্যজিৎ রায়ের শাখাপ্রশাখা ছবির দীপঙ্কর দে-র ডায়লগটা আর শোনাই যাচ্ছে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন