Advertisment

মেঘ-রাজ্যে কেন কংগ্রেস-পতন, জাতীয় লক্ষ্যে কোথায় তৃণমূলের ঘোড়া?

মেঘ-মুলুকে মুকুল ঝরানোর মূল কারিগর কিশোর, গতিপ্রকৃতি সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, মত অনেকেরই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Mukul Sangma

মুকুল সাংমা। ফাইল ছবি

মেঘালয়ে কংগ্রেস ধ্বস্ত। ঘন মেঘের অন্ধকারে সোনিয়া-রাহুলের দল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমার নেতৃত্বে ১৭ জনের মধ্যে ১২ জন কংগ্রেস বিধায়ক এখন তৃণমূলে। ফলে রাতারাতি বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্টি। কংগ্রেসে রক্তক্ষরণের এটা নবতম অধ্যায়। অরুণাচল প্রদেশের ২০১৬ সালের উদাহরণ এই প্রসঙ্গে তুলে ধরা যেতে পারে। সে বছরের ২১ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু সহ অরুণ-রাজ্যের কংগ্রেসের ৪৪ জন বিধায়কের মধ্যে ৪৩ জন পিপলস পার্টি অফ অরুণাচলে যোগ দিলেন, ফলে ক্ষমতায় থেকে গেলেন পেমা। তার পর খান্ডুদের দল যোগ দেন বিজেপিতে। অরুণাচলে এই ভাবে বিজেপি রাতারাতি ক্ষমতাসীন হল। ঠিক যেমন তৃণমূল মেঘরাজ্যে বিরোধী দল।

Advertisment

মুকুল কেন ক্ষুব্ধ

শিলংয়ের সাংসদ ভিনসেন্ট পালাকে মেঘালয়ের রাজ্য সভাপতি করা হয় অগস্টে, তাতে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলের নেতা মুকুল চটলেন। সেপ্টেম্বরে পালা-র অভেষেক অনুষ্ঠানেও হাজির ছিলেন না মুকুল এবং গারো পাহাড় এলাকা থেকে আসা বিধায়করা। অতঃ কিম? অক্টোবরের শুরুতে মুকুল কলকাতা এসে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দেখা করেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গেও। যদিও তখন মুকুল সাংমা এ সব ডাহা অস্বীকার করেছিলেন। এবং তাঁদের দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়। অক্টোবরের ৪ তারিখ রাহুল গান্ধির তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। এক দিকে মুকুল, অন্য দিকে পালা-- ছবি ওঠে। একতার বার্তা দিতে চেয়েছিল কংগ্রেস, কারণ উপনির্বাচন তখন দোরগোড়ায়। যদিও কাজের কাজটি হয়নি, তিন কেন্দ্রেই উপভোটে কংগ্রেস হেরেছে তার পর। কংগ্রেস সূত্রে জানা গিয়েছে, সাংমা বেশ কিছু দিন ধরেই দলীয় কাজকর্মে কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না, যদিও তাঁকে দক্ষিণ-পূর্ব কোঅর্ডিনেশন কংগ্রেস কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। আর একটি কারণও সামনে আসছে। যা একটু শুনলে একটু অবাক লাগতে পারে। সূত্রের খবর, প্রচারে বড় মাপের খরচ করতে পারবে না কংগ্রেস, মনে করেছিলেন মুকুলরা, এবং উল্টো দিকে তাদের মত এই যে-- ফান্ড দেওয়ার সেই ক্ষমতা নাকি তৃণমূলের আছে।

কিশোরের কৌশল

গত দু'মাস ধরে প্রশান্ত কিশোরের টিম শিলংয়ে। মেঘ-মুলুকে মুকুল ঝরানোর মূল কারিগর কিশোর, গতিপ্রকৃতি সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, মত অনেকেরই। তাঁরা বলছেন, যাতে দল-বিরোধী আইন কার্যকর না হতে পারে, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়ককে ঘাসফুল রঙে ছোপানোই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। সেই টার্গেটে চাওয়ার চেয়ে পাওয়া গিয়েছে বেশি। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শেষ পর্যন্ত কিচ্ছুটি করার ছিল না। ধাপে ধাপে সব চেষ্টাই ব্যর্থ। শেষ বড় চেষ্টাটা কী ছিল? এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) কে সি বেণুগোপাল এবং এআইসিসি-র মেঘালয়ের ইনচার্জ দেখা করেছিলেন মণীশ চত্রথ, মুকুল সাংমা, ভিনসেন্ট পালা এবং সিনিয়র নেতা যেমন চার্লস পিঙ্গরোপ, এমপিসিসি-র কার্যকরী সভাপতি আম্পারিন লিংদো, মার্থন সাংমা, জেমস লিংদোদের সঙ্গে। নভেম্বরের ১৮ তারিখ হয়েছিল এই বৈঠক।

বৈঠকের পর সাংমা এবং পালা যৌথ বিবৃতি জারি করেন। যেখানে একতার বার্তাও দেওয়া হয়। বলা হয়, ২০২৩-এর নির্বাচনে তাঁরা এক হলে লড়াই করবেন। কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় এখন বুঝছেন, তত দিনে সাংমার চাকা ঘুরে গিয়েছে অন্য দিকে। কিছু আর করার ছিল না।

তৃণমূলের জাতীয় লক্ষ্য

আইপ্যাকের পঞ্চেন্দ্রিয় প্রশান্ত কিশোর। এ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপিকে হারানোর পিছনে একটা তুখোড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, যা জনে জনে বলে থাকে। তাঁর মগজাস্ত্র না থাকলে তৃণমূলের তরি এ যাত্রায় ঘাটে ভিড়ত না হয়তো, বলা হচ্ছে। তাঁরা কী অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সেখানে পড়ে রয়েছেন, একটু আগেই বলেছি। আসলে বাংলায় নির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের পর, তৃণমূলের সামনে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা উন্মোচিত। সেই লক্ষ্যে মমতার ঘোড়া প্রশান্ত-- গোয়ায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরো এবং আরও এক দল কংগ্রেস নেতা তৃণমূল-ভুক্ত, সেই পথেই লাফ।

এখানে বলতে হবে, এই তো সে দিন রাহুল গান্ধি এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধিদের যোগাযোগে ছিলেন কিশোর মহাশয়, কংগ্রেসে যোগ দিতে পারেন বা চলেছেন তিনি, এমনও খবর হল। শোনা যাচ্ছে, কংগ্রেসের কিছু সিনিয়র পার্টি নেতা তা চাইছিলেন না, তাতেই কংগ্রেসে কিশোর-যোগ বরফের ঘরে চলে গিয়েছে। অনেকের মত, বেশ কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচন যখন নকনকাচ্ছে, তখন কংগ্রেসে প্রশান্ত কিশোর এলে সেইটি একটা মাস্টারস্ট্রোক হত, প্রবাহ এখন যে দিকে এগচ্ছে, সে দিকে নাও এগতে পারত।

কংগ্রেসে বিশৃঙ্খলা

২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচন, সেই সময়ের শাসক দল কংগ্রেস, ৬০ আসনের বিধানসভায় ২১ আসন পেয়ে বৃহত্তম দল হল, কনরাড সাংমার ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, কনরাড এখন মুখ্যমন্ত্রী, পেয়েছিল ১৯টি আসন, মানে দলগত মানচিত্রে মেঘালয়ে ছিল তার স্থান দ্বিতীয়। এর পর… বিজেপির কৌশলে এনপিপি এবং আরও কয়েকটি ছোট দলের হাতে হাত, এবং ক্ষমতার মুকুট থেকে দূরে রয়ে গেল কংগ্রেস। কংগ্রেসের তাবড় নেতারা ছুটে গিয়েছিলেন তখন শিলং। তার মধ্যে ছিলেন প্রয়াত আহমেদ প্যাটেল, সিপি জোশী, মুকুল ওয়াসনিক এবং কমল নাথ। শেষ-ছবিটা থেকে জলের মতো বোঝা গেল হিমন্ত বিশ্বশর্মাই খেলাশেষের বাঁশি বাজিয়েছেন।

সবচেয়ে বড় দল হলেও, ক্ষমতা থেকে মেঘালয়ে যেভাবে দূরে রয়ে গেল কংগ্রেস, সেটাই তাদের মেঘ-গলনের শুরু। সমস্যা দিনকে দিন বাড়ছিলই। পালাকে রাজ্য সভাপতি করায় সেইটা সীমানা ছাড়িয়ে তৃণমূলে হারিয়ে গেল। এক সময়ে কংগ্রেসের দাপুটে মমতা, তাঁর দল তৃণমূলের বিরাট উত্থান হল মেঘালয়ে, কংগ্রেস ভেঙেই। একেবারে বিরোধী দলের জুতোয় পায়ে গলিয়ে। অনেকেই বলছেন, আচ্ছা বিজেপির দরজা দিয়ে এঁরা ঢুকে যেতেই পারতেন, গেলেন না কেন? এখানেও প্রশান্ত কিশোরের হাতযশ। বিশ্লেষকদের একাংশের মত, কংগ্রেস থেকে দর্শনগত ভাবে বিজেপি নয়, বরং তৃণমূলে যাওয়াটাই যথার্থ, বিধায়কদের প্রশান্ত এটাই বোঝাতে পেরেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে।

আরও পড়ুন বিজেপি পিছলে যাচ্ছে বাংলায়, উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়ের ময়নাতদন্ত

ছায়া ক্রমে আসিতেছে। মেঘালয়ে মুকুলরা, গোয়ায় ফেলেইরো-রা যেমন, তেমনই অসমে সুস্মিতা দেব, উত্তর প্রদেশে ললিতেশপতি ত্রিপাঠীরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, বাংলা জয় করে জাতীয় স্তরে মমতার দল এই ভাবে দিল্লির দিকে ঘোড়া ছুটিয়েছে। এত দিন কংগ্রেস অভিযোগ করত, তাদের দল ভাঙিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় পৌঁছচ্ছে, বা সেই লক্ষ্যে ঝাঁপ দিচ্ছে, এখন বিরোধীদের মধ্যেই, তৃণমূলের মতো কংগ্রেসি মতাদর্শের দলের বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযোগ করতে হচ্ছে। যা কংগ্রেসের পক্ষে একশো শতাংশ বিড়ম্বনার।

এবং, বিজেপি-বিরোধী শক্তি এর ফলে ধাক্কা খাচ্ছে জোরদার ভাবে, কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে সেই সমঝোতা তো পঞ্চভূতে বিলীন। ফলে বিজেপির বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াইয়ে যে লক্ষ্য বিরোধী শিবিরে মন্ত্র হয়ে উঠেছিল, সেই মন্ত্রের শব্দগুলি থেকে বলভরসা যেন খসে পড়ছে। এতে বিজেপিই লাভবান হবে, শোনা যাচ্ছে এমনও গুঞ্জন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Meghalaya Mukul Sangma CONGRESS tmc
Advertisment