Advertisment

বিতর্কে কাঁপছে বিশ্বভারতী, আন্দোলন থেকে অনশন, চলছেই, কেন?

শিক্ষাঙ্গনে এভাবে আর কত দিন তর্ক-হাতির দাপাদাপি চলবে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

শিক্ষাঙ্গনে এভাবে আর কত দিন তর্ক-হাতির দাপাদাপি চলবে?

একটি টক শো-তে সেদিন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে 'বড় পাগল' বললেন বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। বললেন, 'বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বড় পাগল, আর রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ ছোট পাগল।' দিলীপ ঘোষ ও তাঁর প্রসঙ্গে অনু-উবাচ নিয়ে এই লেখায় কিছু বলতে চাই না, কারণ, এই লেখা বিশ্বভারতী সংক্রান্ত। হ্যাঁ, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথের হাতে-গড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তাঁর সম্পর্কে এ হেন মন্তব্য, রাজ্যের সারস্বত চিত্রের দৈন্যই সামনে আনছে। এখানে এক ঝলকে স্মর্তব্য তথাকথিত রাজনীতির আগুন-প্রবণতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা কবি শঙ্খ ঘোষকে কী ভাবে অনুব্রত তুলোধনা করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ।

Advertisment

শঙ্খবাবুর 'রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন' তাঁর তেলে যে ভাবে বেগুন ফেলে দিয়েছিল আর অনুব্রত শঙ্খ ঘোষকে বেনজির ও ভয়াল ভাবে 'মিথ্যেবাদী কবি' বলে আক্রমণ শানিয়েছেন, তাঁতে রাজ্যের লোকজন বাকবিহ্বল হয়ে পড়েন। অনুব্রতবাবু অবশ্য নির্দ্বিধায় নিজের ডিফেন্সে বক্তব্য পেশ করে গিয়েছেন তার পর। ফলে গেরুয়াধারণের দোষে গুরুতর ভাবে অভিযুক্ত বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সম্পর্কে যা-খুশি বলাটা তো তাঁর পক্ষে অতি-স্বাভাবিক, বা জলভাত বলে যেতে পারে। এটা নতুনও কিছু নয়, আগেও বলেছেন এ জাতীয়, বার বারই। বলা যায়, বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সম্মুখসমর সপ্তম সুরে উঠে গিয়েছে বেশ অনেক দিন হয়ে গেল।

নির্বাচন পরবর্তী প্রো-নর্মাল (প্রশান্ত কিশোর যে নর্মালের জন্মদাতা), সেটাই নব-উচ্চতায়। এখন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী নতুন করে কাঠগড়ায়। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে বিশ্বভারতীর ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশ বিক্ষোভরত। অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎবাবুর বাড়ির প্রায় দোরদোড়ায়। আদালতের নির্দেশে সেখান থেকে তাঁদের বিক্ষোভস্থলের দূরত্ব বেড়েছে। আদালত বলেছে, উপাচার্যের ভবন থেকে ৫০ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাতে পারেন ছাত্ররা।

কেন ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন?

অগস্টের ২৩ তারিখ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সোমনাথ সৌ, ফাল্গুনী পান, এবং রূপা চক্রবর্তী নামে তিন ছাত্রকে বহিষ্কৃত করেন। অভিযোগ, তাঁরা ৯ জানুয়ারি ছাতিমতলায় বিক্ষোভ দেখানোর নামে বিশ্বভারতীয় শিক্ষা-পরিবেশ কলুষিত করেছেন। তদন্ত-কমিটির রিপোর্ট বলছে, বিশ্বভারতীর শান্ত বাতাবরণ নষ্ট করেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সুনাম রক্ষার স্বার্থেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই একই দিনে দুই অধ্যাপককেও সাসপেন্ড করা হয়, যাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের। আর শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে এ পর্যন্ত সাসপেন্ড ২০ জন।

এর বিরুদ্ধে ২৭ অগস্ট উপাচার্যের বাড়ির সামনে ওই অবস্থান বিক্ষোভের শুরুয়াত। বিক্ষোভকারীদের সহজ ও স্পষ্ট দাবি, বরখাস্তের সিদ্ধান্ত খারিজ করতে হবে। ভিসি-কে সরাতে হবে। বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশন (VBUFA)এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। উপাচার্যকে কাঠগড়ায় তুলে মিছিল হয়েছে শান্তিনিকেতনে। নাগরিক সমাজের বড় একটি অংশও বিদ্যুতে নিদারুণ বিরক্ত।

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ভর্তি-প্রক্রিয়া স্থগিত করেছেন আপাতত। তাঁদের সওয়াল, উপাচার্যের সশরীর উপস্থিতি প্রয়োজন ভর্তি সংক্রান্ত কাজকর্মে। বিক্ষোভের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি, যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় ফল প্রকাশ করাও সম্ভব নয় বলে তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতে লিখিত আবেদন দায়ের করে বলেন, চলতে থাকা বিক্ষোভ বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হোক। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী চিঠি লিখে এই কাণ্ডকারখানায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চান। বিশ্বভারতী মামলার জেরে আদালত ৫০ মিটার দূরে বিক্ষোভ আন্দোলন সরানোর নির্দেশ দিলেও বিক্ষোভ বন্ধের নির্দেশ দেয়নি, যা বিদ্যুৎবাবুদের কাছে মোটেই আরামের খবর নয়। রবিবার থেকে নয়া স্থানে আন্দোলন শুরুও হয়েছে। অনশনে বসেছেন সংগীত ভবনের ছাত্রী রূপা চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য, এঁরা দু'জনেই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কোপে পড়েছেন ।

বিশ্বভারতীর পুরনো বিবাদ

বিশ্বভারতীর অপর নাম হয়ে উঠেছে এখন-- বিবাদ-বিসংবাদ। বারবার বিতর্কে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। পৌষমেলা নিয়ে যেমন, তেমনই অমর্ত্য সেনকে বিশ্বভারতীর জমির বেআইনি দখলদার বলায় ধুন্ধুমার তর্ক। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এসএফআইয়ের তীব্র বিরোধের মুখে পড়েন। একটি ঘরে সাত ঘণ্টা বন্দি হয়ে থাকেন সাংসদ স্বপন।

পৌষমেলা বিতর্ক

গত বছরের অগস্টে বিশ্বভারতীর পৌষমেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নিয়ে হুলস্থূল বাঁধে। তৃণমূলকে মূল চরিত্রে দেখা গেলেও, কার্যত তা জনরোষের চেহারা নিয়ে নেয়। ১৮ অগস্ট একটি মিছিল থেকে ব্যাপক ভাঙচুর চলে। ভুবনডাঙা বাঁধ লাগোয়া মেলা-মাঠের মূল প্রবেশ দ্বার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় পে-লোডারে। আট জনকে গ্রেফতার করা হয় এই ঘটনায়। পরপরই দুবরাজপুরের তৃণমূল বিধায়ক নরেশ বাউরি, বোলপুর পুরসভার দুই বিদায়ী কাউন্সিলর শেখ ওমর এবং সুকান্ত হাজরা-সহ ৯ জনের নামে বিশ্বভারতী অভিযোগ দায়ের করে শান্তিনিকেতন থানায়।

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরার কাজ হচ্ছিল। যদিও অনেকেরই পাল্টা বক্তব্য, মোটেই তা নয়। ভুল বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বহিরাগত বলে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী যে বিতর্ক তৈরি করলেন, তাকে অনেকে বিতর্কের নোবেলপ্রাপ্তিও বলে কটাক্ষ করেন। অনেকে তখনই তাঁকে অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে একাসনে বসান। বলন, অনু-বিদ্যুৎ। 'রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত' কাণ্ডে বিদ্যুৎবাবু ক্ষমা চেয়েছেন অবশ্য, তাতে তাঁর মুখরক্ষা হয়েছে কিনা জানা নেই।

এর পর গত বছরের শেষ থেকে অমর্ত্য সেনকে নিয়ে পড়েন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা বেআইনি ভাবে দখল করে আছেন অমর্ত্য সেন, অভিযোগ এমনই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অমর্ত্যের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে চিঠি লেখেন। মমতার বক্তব্য ছিল, 'অমর্ত্য সেন আদর্শগত ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে বলেন বলেই এ সব হচ্ছে। এটা বাংলার মানুষ সহ্য করবে না। অমর্ত্য সেনের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।' জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের ফের অভিযোগ, অমর্ত্যের বাড়ি প্রতীচী ১৩ ডেসিমেল জমি বেআইনি ভাবে দখল করে আছে। ১৬ জানুয়ারি রেজিষ্ট্রার অশোক মাহাতো সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, 'বিশ্বভারতীর কাছে যে তালিকা রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে অমর্ত্য সেন বিশ্বভারতীর জায়গা দখল করে আছেন। প্রয়োজনে রাজ্য ভূমি সংস্কারের তরফে নিয়ম মেনে বিশ্বভারতীর প্রতিনিধি, অমর্ত্য সেনের প্রতিনিধি সবাইকে নিয়ে জমির মাপ করা হোক, তাহলেই আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।'

বিদ্যুৎ-বিতর্ক আরও দীর্ঘ। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে এভাবে আর কত দিন তর্ক-হাতির দাপাদাপি চলবে? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে এ সব দেখে তিনি মূর্ছা যেতেন, তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই আমাদের। এবং বুঝে যেতেন নিজের সেই গানের মানে, হাড়ে হাড়েই-- তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি…। হ্যাঁ, এখন বিশ্বভারতীর রিংটোন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Visva-Bharati University
Advertisment