হাওয়া-বাতাস দূষিত। শ্বাস নিতে গেলে মাথা ঘুরছে। থিকথিকে ধুলোকণা। চারদিকে। এত দিন লকডাউন হয়ে রইল। চার দিক ভয়ঙ্কর ভাবে হয়ে রইল সুনসান। কলকারখানা কপাট বন্ধ হয়ে রইল। তাতেও দূষণের বিরুদ্ধে জেতা গেল কতটা? না, জেতা যায়নি। ল্যানসেট কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ বলছে, এমন জাতীয় সব দূষণে মৃত্যুর হার বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এর যেন বিরাট বাড়বাড়ন্ত।
আসুন আমাদের দেশের কথায় আসা যাক।
বায়ু দূষণের মামলায় ভারতের হাল বেহাল। পৃথিবীর যে সব দেশগুলির বায়ু দূষণে জর্জরিত, নিপীড়িত, তার প্রথম দিকেই পড়বে আমাদের এ দেশ। আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু তো কোথায় হাওয়া, এখন একটু বাঁচবার জন্য খাবি খেতে হচ্ছে আমাদের। তাও গ্রামগুলি এক রকম, কিন্তু শহরে দূষণের বহর প্রতি ক্ষণে বাড়ছে। বড় বড় কথা বলা হচ্ছে। নেট জিরো-র এক হাত দুহাত তিন হাত লম্বা সব প্রতিশ্রুতি শোনা যাচ্ছে। নেট জিরো মানে হল, যে পরিমাণ কার্বন বায়ুতে ছাড়া হবে, সেই পরিমাণ কার্বনই বায়ু থেকে বার করে নেওয়া হবে। গ্লাসগোয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০৭০ সালের মধ্যে নেট জিরো-র লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেই দিকে এগিয়ে যাওয়ায় আমাদের দেশ কতটা সিরিয়াস, সেই প্রশ্ন তুলছেন নানা প্রকৃতিপ্রেমিক। ফসিল ফুয়েল, জ্বালানি হিসেবে যা ব্যবহার করা যাবেই না আর, বদলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তিকে সভ্যতার চালিকাশক্তি করতে হবে, সেই পথে যতটা দ্রুত হাঁটা উচিত ছিল, তা-ই কি হচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে?
আসুন বায়ু দূষণের জেরে যে ভাবে মৃত্যু বাড়ছে সেই দিকে নজর দিই।
ল্যানসেট কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ রিপোর্ট বলছে, দূষণের ফলে প্রাণশক্তি সময়ের আগেই থেমে যাচ্ছে মোটামুটি ছ'টি অঞ্চলে। ভারত, চিন, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৫টি দেশ হল এই ছয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০ সালে দূষণের ফলে প্রাণক্ষয়ে ভারতের উৎপাদন যে পরিমাণ কমেছে, তা এ দেশের জিডিপি-র ৩.২ শতাংশ। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আধুনিক মার্গীয় নানা দূষণের জেরে আর্থিক ক্ষতির বহর বেড়েছে ভারত, চিন এবং নাইজেরিয়ায় বেশ খানিকটা। হিসেবে বলছে, তা জিডিপির মোটামুটি এক শতাংশ।
সব মিলিয়ে দূষণের জেরে ৯ মিলিয়ন বা ৯০ লক্ষ মানুষ মারা যান প্রতি বছর, সময়ের আগেই ফুরিয়ে যাওয়া এ ভাবে, প্রতি পৃথিবীতে প্রতি ছ'জনের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হচ্ছে দূষণে। নানা ধরনের দূষণের মধ্যে বায়ু দূষণই দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে প্রাণ কাড়ছে। ২০১৯ সালে এর কোপে ৬০ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের ধুকপুকুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জলদূষণের ফলে ওই বছর মৃত্যু হয়েছে ১০ লক্ষ ৪০ হাজারের।
আরও পড়ুন Explained: পাইকারি বাজারের প্রবল পায়াভারী, মুদ্রাস্ফীতি রুখতে আরও সুদ-বৃদ্ধি কি আসন্ন?
আসুন দূষণের পরিমাপটা একটু তলিয়ে করা যাক।
ফসিল ফুয়েল, পেট্রোলিয়াম, কয়লা ইত্যাদি-- এ সব জ্বলে সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ দূষণ হচ্ছে, তার পরিমাপ কত জানেন? প্রতি দিন মোটামুটি এর পরিমাপ ৮০০ কোটি ডলার। ২০২১-এর গ্লিনপিস-এর এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট অনুযায়ী ( যা মার্চে প্রকাশ পেয়েছে), সারা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত রাজধানী নয়া দিল্লি। উত্তর ভারত, দিল্লি সহ, এই দূষণের ফলে ৩০ লক্ষের মৃত্যু হয়েছে, বলছে ওই রিপোর্ট। এই মৃত্যুর ফলে ৬ কোটি ২৭ লক্ষ বছরের মতো জীবন কম পেয়েছি আমরা।
ল্যানসেটের হিসেবে ভারতের ৯৩ শতাংশ অঞ্চল ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের গাইডলাইন্সের চেয়ে বেশি দূষণ হয়ে থাকে। এটি বলছে, ২০১৯ সালটিই এখনও পর্যন্ত সেই বছর, যখন দূষণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ দেশে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা সত্ত্বেও এত মৃত্যু! যে প্রকল্প ২০১৬ সালে চালু করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। গ্রামে গ্রামে রান্নার গ্যাস পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই প্রকল্প। যদিও ২০১৯ সালে কোলাবোরাটিভ ক্লিন এয়ার পলিসি সেন্টার বলে, বিপুল সংখ্যক বাড়িতে মাটির উনুনে, কাঠ-কয়লা ইত্যাদির জ্বালানি পুড়িয়ে রান্নার করা বায়ু দূষণের একটি বড় কারণ।