Advertisment

WHO-র নয়া দূষণ-নিয়মে ভারতের মহাসমস্যা, কেন?

পৃথিবী জোড়া পরাবাস্তব প্রকৃতি দেখে এমন কড়াবস্থান না নেওয়া ছাড়া WHO-র উপায় ছিল না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
WHO, Pollution Explained

WHO-র নয়া দূষণ-নিয়মে ভারতের মহাসমস্যা

ঘন মেঘ বলে ঋ/ দিন বড় বিশ্রী। দিন শুধু বিশ্রী নয়, ভয়ানক। জলের তলায় জীবন। জলবৎ তরলং সভ্যতা। মানুষের ব্রেন যেন জলে গলে যাচ্ছে। কোথাও বৃষ্টি অনর্গল, আবার কোথাও হড়পা বানে মুহূর্তে তছনছ সব। এটা গেল তো এ রাজ্য, এ দেশের হাল। পৃথিবীর অন্য পিঠ আবার গনগন করে সব পুড়ছে। দাবানলে খাক হয়ে যাচ্ছে বাইডেন-ভূমির একের পর এক এলাকা। মাঝ-অগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তর দিকের আগুন তো শিহরণ ধরিয়ে দিয়েছিল। তা হলে ঢং ঢং করে শেষের ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে? প্রবল মায়াবী এই পৃথিবীর কি এটাই অন্তিম কাল?

Advertisment

দূষণ। উষ্ণায়ন। এই শব্দগুলি চলতি হাওয়ায় অনেক দিন হল ঘুরছে। হাল-ফ্যাশনের মতো। সে দিন পর্যন্ত পিঠ পুড়লেও আমরা ফিরে শুচ্ছিলাম, এখন প্রকৃতি দেবীর রাম চিমটি খেয়ে বোধ হয় ধড়মড়িয়ে জেগে উঠেছি। আমরা এক ঘুমে সকাল করতে অভ্যস্ত, মাঝখানে উঠতে বিস্তর কষ্ট হচ্ছে। ঘুম সবার ভেঙেছে বলা যাবে না, অনেকের নাসিকাগর্জন এখনও বাতাসে কালো ধোঁয়ার সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে ভাসছে। চোখকান খোলা রাখলেই তা ইন্দ্রিয়ের অন্দরটা চাবকে দেবে।

যা হোক, যথেষ্ট ভ্যান্তারা হল। এবার প্রসঙ্গে আসি। আমাদের দূষণ নিয়ে কিছু বলবার রয়েছে। প্রতি বছর শীত শুরু হতেই দিল্লির দূষণ নিয়ে লাগাতার স্টোরি করতে হয় মিডিয়াকে। হরিয়ানায় ফসলের গোড়া পোড়ানো এবং গাড়িঘোড়া-কলকারখানার ধোঁয়া সব মিলে এক বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। ধোঁয়াশার গ্রাস। রাজধানী ঢাকে কালোয়। গ্রেট স্মগ যাকে বলা হয়ে থাকে। ১৯৯৯ সালের পর থেকে এই সমস্যাটা যেন দিল্লিজীবনের অঙ্গ। আর বারবার পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০-- এ দুটি মাপকাঠির কথা বলে থাকি আমরা। দূষণের দুনিয়াটা বুঝতে যা অতি-গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখন।

বুধবার WHO বায়ু দূষণ বিধিতে এই দুটি মাপকাঠি আরও কড়া করে দিয়েছে। ভারতের বাতাসকে কড়া নিগড়ে বাঁধার ব্যবস্থা হয়েছে নয়া নিয়মে। আগে হু-র বিধি অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় প্রতি বর্গ মিটারে ২৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকাটাকে সুরক্ষিত বলে ধরা হত, কিন্তু হু এখন বলছে এইটি হতে হবে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। পিএম ২.৫ ছাড়াও পিএম ১০, ওজোন, নাইট্রোজেন, সালফার এবং কার্বনডাই অক্সাইডের মতো বায়ু দূষণের সঙ্গে জড়িত ছ'টি মাপকাঠিরই ঊর্ধ্বসীমা নামানো হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৫ সাল থেকে যা নির্দিষ্ট ছিল, তা হুস করে অনেকটা কমেছে। পৃথিবী জোড়া পরাবাস্তব প্রকৃতি দেখে এমন কড়াবস্থান না নেওয়া ছাড়া হু-র উপায় ছিল না।

পিএম ২.৫, পিএম ১০

পিএম ২.৫ ও পিএম ১০ দূষণের টিমে দুই স্ট্রাইকার। পিএম ২.৫ অবশ্যই ১০ নম্বরি। এ দুটি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যেতে পারে এই ফাঁকে। পিএম মানে পার্টিকুলেট ম্যাটার। এগুলি শক্ত-তরল পার্টিক্যল বা কণা, বায়ুতে মিশে থাকে। অতিসূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম এবং তুলনায় গায়েগতরে ভারী-- পার্টিকুলেট ম্যাটার এমন বহুরূপী হয়ে থাকে। পিএম ২.৫ বলতে বোঝায়-- যে সব কণার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটার কিংবা তার চেয়ে ছোট। মানুষের চুলের ব্যাস ৫০ মাইক্রন, ফলে বোঝাই যাচ্ছে এই কণাগুলি কতটা ছোট হয়। ক্ষুদ্রতাই এর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার কারণ। সুচ হয়ে ঢুকে এগুলি ফাল হয়ে যায়। নাকের ভিতরের রোম, শ্লেষ্মা এবং অন্যান্য প্রতিরোধ টপকে এরা ফুসফুসে ঢোকে গটমটিয়ে। এবং পৌঁছে যায় রক্তের ভিতর। তার পর নানা রোগ ডেকে আনে একে একে। দাবানলে এই ভয়ঙ্কর কণার জন্ম হয়, ফসলের গোড়া পুড়লেও হয়, আবার বিভিন্ন কারখানা থেকে বেরিয়ে আসা বিষ রাসায়নিক ধোঁয়াতেও এই কণা ভূরি ভূরি থাকে, গাড়ির ধোঁয়াও এর জন্মের একটা বড় কারণ। দিল্লিতে যে ধোঁয়াশা আমরা দেখতে পাই, তা অনেকটাই এই পিএম ২.৫-এর জন্য।

কী অসুখ হবে?

কণাগুলি শরীরে সেঁধালে শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন আসুখ হতে পারে, হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে এই দূষণে। ২০১০-এর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কিছু ঘণ্টা কিংবা কয়েক সপ্তাহ যদি এই কণা-মেশা বায়ু নিতে থাকেন, তা হলে আপনার জীবনীশক্তি কমে যাবে। এ দেশ এই পিএম ২.৫-এ জর্জরিত। নাসার উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, সেফ লিমিট থেকে ৫ গুণ বেশি পিএম ২.৫ থাকা বাতাস নিচ্ছে ১০ জনের ৪ জন ভারতীয়। আর পিএম ১০ কী? বায়ুতে থাকা যে সব পার্টিকুলেট ম্যাটারের ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে কম, তাকেই পিএম ১০ বলে। যেহেতু এরা তুলনায় বড়, তাই এদের দেহের প্রতিরোধ শক্তি ধরে ফেলতে পারে অনেক ক্ষেত্রে। আপনার নাক-চোখে ইরিটেশন তৈরি করে এরা, এবং বড়ত্বের কারণে অনেক কম সংখ্যায় গিয়ে পৌঁছয় ফুসফুসে। পিএম ২.৫-এর চেয়ে পিএম ১০ কম মারাত্মক তাই, প্রাণঘাতী নিঃসন্দেহে।

দূষিত পৃথিবী ও WHO

হু বলছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ু দূষণ, তাই মাপকাঠির নয়া পরিবর্তন অতি জরুরি ছিল। ভারত এতে নিদারুণ চাপে পড়ে যাচ্ছে। নতুন এই এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইন্সের মানে হল, প্রায় সারা দেশ দূষণ-ক্ষেত্রের আওতায়। গাইডলাইন্সের এই বাউন্সার সামলানো তাই মোটেই সহজ হবে না আমাদের পক্ষে। হু-র ২০০৫ সালের নির্দেশিকা বলছে, ২৪ ঘণ্টায় প্রতি বর্গ মিটারে ২৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকতে হবে, ভারতে যা রয়েছে ৬০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। ফলে আমাদের পক্ষে নয়া গাইডলাইনে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভবই বলা যেতে পারে।

ভারতের ৯৫ শতাংশ এলাকা হু-র ২০০৫ সালের নির্ধারিত দূষণ-নিয়মকে ছাপিয়ে গিয়েছে। জানাচ্ছেন গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডির সঙ্গে যুক্ত ফুসফুসের অসুখ বিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপ সালভি। ভারত শুধু নয়, পৃথিবীর বহু অঞ্চলই রাতারাতি দূষণ-ভূমি হয়ে যাচ্ছে এতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীর ৯০ শতাংশ জনবসতিই ২০০৫-এর গাইডলাইন ভঙ্গ করছে, আরও কঠোর গাইডলাইনের ফলে দূষণ-এলাকার পরিধি স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেড়ে যাবে।

হয়তো জানেন যে, আমাদের 'মাতরম' সারা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত দেশ। দূষণের মাপকাঠিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই এগিয়ে চলেছি আমরা। কারণ, নির্ধারিত স্তরের তোয়াক্কা আমাদের রক্তে নেই। আমরা নির্ভীক, নির্ভয়, নির্ভার। কিছুতেই আমাদের রোখা যাচ্ছে না। দিল্লির উদাহরণ ফের সামনে আনা যেতে পারে। ২০২০ সালে রাজধানীতে পিএম ২.৫ ছিল নির্ধারিত মাপকাঠির চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। এক দিনে যে এমনটা হয়নি, গত কয়েক বছরের দূষণ-বৃদ্ধির খতিয়ানে তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আগে থেকে ব্যবস্থা কী নেওয়া হয়েছে, সেই প্রশ্নে ধোঁয়াশা আরও ঘন। দূষণ নিয়ে তরজায় মেতে ওঠাটাই হেডলাইন হয়েছে বার বার। সুপ্রিম কোর্টেও দিল্লির দূষণ হাজির হয়েছে। আর, মুম্বইয়ের দূষণ-মাত্রা ছিল, ২০২০ সালে, নির্ধারিত মানের আট গুণ বেশি। চেন্নাইয়ের ছিল পাঁচ গুণ বেশি।

কী পদক্ষেপ

বিজ্ঞানীদের অনেকের মত, এতে পরিস্থিতিটা যে কতটা সঙ্গীন নয়া গাইডলাইন্সে সেই বার্তা দিচ্ছে হু। হু তার কাজ করেছে। এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ভারতকে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলিকেও, বিশেষ করে গোটা এশিয়াকে এক সঙ্গে মাঠে নামতে হবে। গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে, অন্য সব যুদ্ধ থামিয়ে। তু তু ম্যাঁয় ম্যাঁয়-- অতি প্রিয় এই পদ্ধতি ছেড়ে। কালীপুজো-দীপাবলিতে বাজি না ফাটিয়ে, কী আলো কি শব্দবাজি সব বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে যেতে পাবে। দোরগোড়ায় এসে গিয়েছে পুজো, এই সঙ্কল্পটা নিতে হবে এই মুহূর্তে।

ভারত কিছু কিছু ব্যবস্থা করেছে দূষণ রোধে। কেন্দ্রের উজ্জ্বলা যোজনা এ ক্ষেত্রে খুবই প্রশংসিত। উনুনের ধোঁয়ায় যেভাবে নারী-ফুসফুসের মড়ক লেগেছিল, তাতে কিছুটা লাগাম দেওয়া গিয়েছে, মনে করেন অনেকে। আরও কিছু প্রকল্প রয়েছে সরকারের। বেশির ভাগই অবশ্য কাগজ থেকে বাস্তবে এসে পৌঁছচ্ছে খুবই ধীরে। ২০১৭-কে ভিত্তি ধরে ২০২৪ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি শহরের দূষণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা কয়েক বছর হল নিয়েওছে ভারত সরকার। কিন্তু সে দিন আলোকবর্ষ দূরে বলে কটাক্ষ করছেন পরিবেশপ্রেমীরা। আমেরিকাও জেগে উঠেছে, দেরিতে হলেও, তা-ই ইলেকট্রিক ভেহিক্যলের সংখ্যা বাড়াতে কোমর বেঁধেছেন বাইডেন। ২০৩০ সালের মধ্যে আমেরিকায় বিক্রি হওয়া গাড়ির ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ইলেকট্রিক চালিত করার টার্গেট নিয়েছে বাইডেন সরকার। আমাদের দেশেও বায়ু-দূষণ রুখতে ইভি (ইলেকট্রিক ভেইক্যল) হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু করেছে। অগস্টের শুরুতে ভারী শিল্প মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী কৃষ্ণ পাল গুর্জর রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তরে জানান, অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি, কর্নাটক, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মেঘালয়, গুজরাত এবং পশ্চিমবঙ্গ-- এই ১৩টি রাজ্য ইভি-নীতি গ্রহণ করেছে।

আমাদের নীতি আছে, নীতিবোধ নেই। ফাইন আছে, আছে তার চেয়ে অনেক অনেক বড় বুড়ো আঙুল। তাই আমরা জলে তলিয়ে যাচ্ছি। আগুনে পুড়ে যাচ্ছি।

Pollution WHO
Advertisment