সংসদে এবার কথা বলতে গিয়ে সাংসদদের রীতিমতো চাপে থাকতে থাকতে হবে। এত দিন যে সব শব্দ একেবারে পপকর্নের মতো করে ফুটেছে তাঁদের মুখে, সেই সবই এখন খরচের খাতায়। না ঠিক খরচের খাতায় নয়, নিষেধাজ্ঞাপুস্তকে ঢুকেছে। বিশেষ করে বিরোধী অনেকেই এতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়তে পারেন। নিষেধাজ্ঞার কোপে পড়েছে যেগুলি, শুনে নিন তার কয়েকটি-- জুমলাজীবী, বাল বুদ্ধি, কোভিড স্প্রেডার, স্নুপগেট, স্বৈরাচারী, শকুনি, তানাশাহ, তানাশাহি, বিনাশপুরুষ, খালিস্থানী, কুম্ভীরাশ্রু। সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে জুলাইয়ের ১৮ তারিখ থেকে। তার আগে, ঝুলি থেকে শব্দভেদী বাণ বার করে চালিয়ে দিয়েছে মোদী সরকার। বিরোধীরা এতে ক্ষুব্ধ, স্বাভাবিক ভাবেই, তাঁদের অনেকের গা যে এতে রি-রি করছে, তা তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন কথায়-ভাবে।
কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধি টুইট করে তোপ দেগেছেন। বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রীর সরকার চালানোকে ঠিক মতো ব্যাখ্যা করার জন্য যে সব শব্দ আলোচনা এবং বিতর্কে ব্যবহার করা হত, সেইগুলিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।' এ লেখার উপরে লিখেছেন রাহুল বড় হরফে-- অসংসদীয়। অভিধান-এর ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে গোটা বিষয়টি। অংসদীয় অর্থটাই যেন এখন থেকে পাল্টে গিয়েছে, এমনই কটাক্ষ করতে চেয়েছেন। নীচে ছোট হরফে রাহুল লিখেছেন, সংসদীয় বাক্যের একটি উদাহরণ: 'যখন তাঁর মিথ্যা ও অযোগ্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন জুমলাজীবী তানাশাহ কুম্ভীরাশ্রু ফেলেন।'
বিরোধীদের প্রায় সকলেই এক বাক্যে বলেছেন, সমালোচনা এবং কঠোর সত্যির মুখোমুখি হতে চান না প্রধানমন্ত্রী, তাই এই ভাবে কণ্ঠরোধের পথে হাঁটলেন। তৃণমূল নেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন টুইটে বলেছেন, 'আমরা এখন থেকে কতগুলো মৌলিক শব্দ বলতে পারব না… লজ্জাজনক। অবমানাকর। বিশ্বাসঘাতকতা। দুর্নীতিগ্রস্ত। দ্বিচারিতা। অযোগ্য। আমি এই সব শব্দই ব্যবহার করব। আমায় সাসপেন্ড করুন। গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি।'
সংবিধানের ১০৫ (২) ধারা বলেছে, যে কোনও কারণই হোক না কেন, সংসদের মধ্যে যা খুশি বলার অধিকার কোনও সাংসদের নেই। রুলস অফ প্রসিডিওর অ্যান্ড কনডাক্ট অফ বিজনেস ইন লোকসভা বা লোকসভার কার্যপ্রণালী ও কার্য পরিচালনা বিধি। এখানে বিষয়টি বেশ স্পষ্ট করে দেওয়াও রয়েছে। এই নিয়মাবলির ৩৮০ নম্বর অনুযায়ী, বিতর্কের সময় যদি এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকেন কেউ, যেগুলিকে অশালীন বা অসংসদীয় বা অসম্মানজনক বলে মনে করেন স্পিকার, তা হলে সেই সব শব্দ হাউজের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।
আরও পড়ুন Explained: নতুন সংসদভবনের অশোক স্তম্ভেও বিতর্কের হাওয়া, ভবন-কথা জানেন?
বিধি ৩৮১ বলছে, কারওর বক্তব্যের যে অংশটি বাদ দেওয়া হবে, সেই অংশে অ্যাসটেরিক্স দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। এবং একটি ফুটনোট দিতে হবে। লিখতে হবে এক্সপাঞ্জড অ্যাজ অর্ডার্ড বাই দ্য চেয়ার, অর্থাৎ স্পিকারের নির্দেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই বহু শব্দ, শব্দবন্ধ রয়েছে যা আনপার্লামেন্টারি বা অসংসদীয় হিসেবে চিহ্নিত। লোকসভায় স্পিকার কিংবা রাজ্যসভার চেয়ারপার্সনের একটি কাজ বলা যেতে পারে এই সব শব্দকে সংসদের বিবরণী থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া। তাঁদের রেফারেন্স এবং সহযোগিতায় লোকসভার সচিবালয় এক ভারী বই বার করে, তার নাম-- আনপার্লামেন্টারি এক্সপ্রেশনস। বাংলা করলে দাঁড়ায়, অসংসদীয় অভিব্যক্তি। এই তালিকার রয়েছে, অনেকে কড়া এবং আক্রমণাত্মক শব্দ, যা কোনও সংস্কৃতিতেই গ্রাহ্য নয়।
কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু শব্দও রয়েছে, বা ঢুকে গিয়েছে, যেগুলি ক্ষতিকর নয় মোটেই, এমনই মনে করেন অনেকে। ১৯৯৯ সালে এই বই প্রথম হয়। সেই সময় শব্দ ও শব্দবন্ধগুলি নেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার আগের সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি, কন্সটিটিয়েন্ট অ্যাসেম্বলি, প্রভিশনাল পার্লামেন্ট এবং প্রথম দশটি লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন, রাজ্য বিধানসভা ও ব্রিটেন সহ কমওয়েলথের কয়েকটি দেশের সংসদ থেকে। ২০১২-তে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এমনটা জানিয়েছিলেন লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল জি সি মালহোত্রা। মালহোত্রা ছিলেন এই বইয়ের ২০০৪-এর সংস্করণের সম্পাদকীয় বোর্ডের প্রধান। বইটির সেই সংস্করণ ছিল ৯০০ পাতার। স্পিকার-চেয়ারপার্সনের নির্দেশ অনুযায়ী বাদ পড়া নানা শব্দ যোগ করে নয়া সংস্করণ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। জানিয়েছিলেন মালহোত্রা।
অসংসদীয় শব্দের আরও কিছু উদাহরণ
রক্তপাত, রক্তাক্ত, বিশ্বাসঘাতক, লজ্জাজনক, গালাগালি, প্রতারিত, শিশুপনা, দুর্নীতিবাজ, কাপুরুষ, অপরাধী, অসম্মান, গাধা, নাটক, আইওয়াশ, গুন্ডামি, ভণ্ড, অযোগ্য, বিভ্রান্তি, মিথ্যা, দাঙ্গা, দালাল, বালবুদ্ধি, দাদাগিরি, দোহরা চরিত্র, বেচারা, ববকাট, ললিপপ, বিশ্বাসঘাতক, সংবেদনাহীন, মূর্খ, বেহরি (কালা) সরকার, যৌন হয়রানি ইত্যাদি।