মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র সুদের হার বৃদ্ধি করা। প্রত্যাশা মতো সেই পথেই এগিয়েছে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ। অনেকেই ভেবেছিলেন, দশমিক ৫০ বা ৫০ বেসিসপয়েন্ট সুদের হার বাড়াবে তারা। কেউ কেউ এমনও ভেবেছিলেন যে, না, ৫০ নয় ৭৫ বেসিসপয়েন্ট সুদের হার বাড়বে। কারণ, তাদের মত ছিল, ফেডারেল রিজার্ভকে আক্রমণাত্মক খেলতে হবে, খেলতেই হবে। সেই কারওর কারওর পূর্বাভাস পূর্ণ করেছেন ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোম পাওয়েল। যা ১৯৯৪ সালের পর, সবচেয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থান বলা চলে। এতটা কড়া পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতির প্রগতি শ্লথ হবে, এবং মার্কিন মুলুকে বেকারত্ব আরও বাড়বে। ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি বা এফওএমসি বলেছে, বেকারত্বের হার সে দেশে এখন ৩.৬ শতাংশ, যা ২০২৪-এ গিয়ে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪.১ শতাংশে। ইতিমধ্যেই আমেরিকায় বেশ কয়েকটি সংস্থা কর্মী ছাঁটাই শুরু করে দিয়েছে।
যদিও গোদা ভাবে ফেডারেল রিজার্ভ মনে করছে না এর ফলে মন্দার গাঢ় ছায়াটা পড়বে আমেরিকায়। আবার, ওয়েলস ফার্গোর মতো হেভিওয়েট ব্যাঙ্কের তরফে বলা হয়েছে, মন্দা আসন্ন, এবং সেটা আগামী বছরই।
সুদ বাড়ানোর পদক্ষেপের আরও কয়েক কথা
মার্চের মাঝামাঝি ফেডেরাল রিজার্ভ এ বছরে প্রথম সুদের হার বাড়ায়। বাড়ানো হয় দশমিক ২৫ শতাংশ। তখনই ইঙ্গিত দিয়েছিল তারা আরও বাড়বে এই হার। এবং সেই মতো মে মাসের শুরুতে বাড়ানো হয় দশমিক ৫০ শতাংশ। তার পর এই দশমিক ৭৫ বৃদ্ধি, মানে চার মাসে সুদের হার বাড়ল ১. ৫ শতাংশ। কিন্তু এবার কেন দশমিক ৫০ শতাংশ হার বৃদ্ধির বদলে দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদের হার বাড়ানো হল? তার কারণ রয়েছে। রয়েছে বটেই। মুদ্রাস্ফীতি যেন একেবারে রকেটের মতো উঠতে শুরু করেছে আমেরিকায়।
গত শুক্রবারই সে দেশের শ্রম দফতর জানায়, কনজিউমার প্রাইজ ইনডেক্স পৌঁছেছে ৮.৬ শতাংশে। যে বৃদ্ধি ১৯৮১ সালের পর এই প্রথম, ৪০ বছরে রেকর্ড। অনেক কিছুরই দাম বাড়েছে হু-হু করে, এর তারই জের। যেমন জ্বালানি, খাবারদাবারের দাম তো চরমে। জ্বালানির দাম এক বছরে বেড়েছে ৩৪.৬ শতাংশ। যা ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এক বছরে ফুড প্রাইজ ইনডেক্স বেড়েছে ১০.১ শতাংশ। ১৯৮১ সালের পর এই প্রথম যেটি ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশের মার্ক। তাই এমন বড়সড় বৃদ্ধি ছাড়া কোনও উপায় ছিল না ফেডারেল রিজার্ভের হাতে।
ভারতে কী প্রভাব?
আমেরিকা সুদের হার বাড়ানোর যে মরশুম শুরু হয়েছে মধ্য মার্চ থেকে, ভারতের শেয়ার বাজারে সেই বৃদ্ধির জল্পনা থেকেই দারুণ টালমাটাল শুরু হয়ে গিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে এ দেশের শেয়ার বাজার থেকে। ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্টের (পিএফআই) এই দশায় বাজার নামছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ক্র্যাশ করে গিয়েছে বলা যায়। ভারতের বাজার থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার বাজারে বিনিয়োগ করতে চাওয়ার লক্ষ্যেই এই পিএফআই খিড়কি দরজা ধরে উধাও হচ্ছে। রেপো রেটও বাড়িয়েছে আরবিআই। ধাপে ধাপে। কিন্তু তাও বাজার স্থিতিশীলতার মুখ দেখছে না।
আরও পড়ুন Explained: আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতির কালো মেঘ, ভারতের শেয়ার বাজারে অন্ধকার আরও গাঢ়, কেন?
এ দিনও আমাদের শেয়ার বাজারে পতনপরিস্থিতি জারি ছিল। ৫২ সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন হাল হয়েছে বাজারের। সেনসেক্স কমেছে ১,০৪৬ পয়েন্ট, মানে ২ শতাংশ, পৌঁছেছে ৫১,৪৯৬ পয়েন্টে। নিফটি কমেছে ৩৩২ পয়েন্ট, বা ২.১১ শতাংশ। পৌঁছেছে ১৫,৩৬০.৬০-এ। ডলারের তুলনায় টাকার দামও পড়ে চলেছে। যদিও বৃহস্পতিবার একটু উঠেছে। তবে ডলার পিছু ৭৮-এর নীচেই রয়েছে রুপি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে এখন সুদের হার বাড়াতে হবে। না হলে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগের চলে যাওয়া আটকানো যাবে না। বলছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। এখানে একটি হিসেব দেওয়া যাক-- এই মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১৪ হাজার কোটি টাকা আমাদের শেয়ার বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন। এই বছরে যে পরিমাণটা ১ লক্ষ ৮১ হাজার কোটি।
আরও পড়ুন Explained: ব্যাঙ্কঋণে বাড়তে পারে ইএমআই, আরবিআইয়ের রেপো রেট বৃদ্ধি বলছে সেকথাই, কী ভাবে?
ভারতে কি মন্দা ঘনাবে?
আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই। কারণ, আমেরিকায় যদি মন্দার ব্যাটিং শুরু হয়ে যায়, তার একটা কু-প্রভাব তো পড়বে এ দেশেও। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ভারত এখন স্ট্যাগফ্লেশনের মধ্য দিয়ে চলেছে। মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির হার হ্রাস পাচ্ছে, সেটাই স্ট্যাগফ্লেশন। স্ট্যাগফ্লেশনকে মুদ্রাস্ফীতিতে মন্দা পরিস্থিতি বা রিসেশন-ইনফ্লেশন বলা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যখন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই যে পচ্ছাদপসরণ পরিস্থিতি চলছে, তাতে আমেরিকা তো বটেই ইউরোপ এমনকি চিনও আগে হোক বা পরে পড়তে পারে মন্দা কবলে, তা হলে ভারত কি রক্ষা পাবে? সে ক্ষেত্রে এখন পা মেপে মেপে ফেলতে হবে। সরকার-আরবিআইকে। জ্বালানির মূল্য কমানো বা তাকে রাখতে হবে একেবারে হাতের মুঠোয়। খাদ্যপণ্যের দামও রাখতে হবে আতসকাচের নীচে। কোনও ভাবে যাতে বেআইনি মজুতদারি না হয় দেখতে হবে সে দিকে। খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রেও শিথিলতা আনতে হবে। কড়া নজর রাখতে হবে পরিষেবা, তথ্যপ্রযুক্তির দিকেও।