করোনার স্পিন চলছেই। এক ঘূর্ণি এসে অন্য ঘূর্ণির মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মাথা বনবন, বায়ু শনশন অবস্থাটা যাচ্ছে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট উদ্বেগের নয়া উৎপাতের খবর দিয়েছে। তা নিয়ে সবাই ব্যস্তসমস্ত এবং তাতে আতসকাচ ফেলতে না ফেলতে জানা যাচ্ছে সেইটি ইজরায়েলে হাজির। করোনার বুলেট গতিতে তাই হাসফাঁস হাল। কোভিডের এই নব চরিত্রে নজর দিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
ভ্যারিয়েন্টের প্রথম পাঠ
B.1.1.529। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের গালভর্তি নাম। মানে সে দেশে এর প্রথম খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও স্বভাবত তৈরি। তার প্রভাব বা ধাক্কাও পড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কাঁটার উপর দিতে হাঁটা তো যাবে না, তাই কোনও ঝুঁকির দিকে এক ডিগ্রিও ঝুঁকতে কেউ চাইছে না।
ভ্যারিয়েন্ট আলাদা কোথায়?
বিজ্ঞানীদের অনেকে বলছেন, B.1.1.529 বেশি সাহসী, তেজস্বী হওয়ার আশঙ্কা -- অনেক বেশি মিউটেশন বা বিবর্তনের ফসল। তার স্পাইক প্রোটিনটিও একটু আলাদা। স্পাইক প্রোটিন হল যার মাধ্যমে শরীরে সেঁধিয়ে যায় ভাইরাস। কোষ আঁকড়ে ধরে ঢুকে পড়ে, শরীরের অ্যান্ডিবডি সক্রিয় হওয়ার আগেই। ভ্যাকসিনকে অনেক সময় ফাঁকিও দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই নয়া ভ্যারিয়েন্ট প্রকৃত পক্ষে কতটা বেশি সংক্রমিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে তা বোঝার চেষ্টায় এখন ব্যতিব্যস্ত। কতটা বেশি প্রাণহরণকারী তাও জানার প্রচেষ্টা চলছে স্বাভাবিক ভাবেই, একই সঙ্গে।
নয়া ভ্যারিয়েন্টের কেমন ধাক্কা
পর্যটনের পৃথিবীতে এই অদৃশ্য শত্রুটি প্রথম দাঁতটি বসিয়েছে। পর্যটন সম্পর্কিত বিনিয়োগ ফুরফুরিয়ে কমে গিয়েছে এর খবরে। বাজার দারুণ ভাবে চাঙ্গা হচ্ছিল, নিমেষে যেন অনেকটা জল শুকিয়ে গেল। আফ্রিকার ছ'টি দেশের উড়ানে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছে ব্রিটেন। পরিস্থিতি যদি মাত্রা ছাড়ায় তা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার উড়ানে ব্যানের বাঁধন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তারা পরিস্থিতির উপর নিখুঁত নজর রেখে চলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা পর্যটকদের স্ক্রিনিংয়ে কোমর বেঁধেছে ভারত। বতসোয়ানা, হংকং থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের একেবারে সপ্তম সুরে চেকআপ করা হচ্ছে। মুদ্রার বাজারেও এর নাকি বেশ প্রভাব পড়েছে। ডলারের তুলনায় ইয়েন বেড়েছে ৪ শতাংশ। ডলার পিছু বেড়ে হয়েছে ১১৪.৯১। দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রাও (Rand) গোঁত্তা খেয়েছে। নেমেছে এক বছরের নীচে।
কোথা থেকে আবির্ভাব?
আবির্ভাব-সংবাদ পুরোটা জানা যায়নি এখনও। নানা জল্পনা চলছে। লন্ডনের ইউসিএল জেনেটিক্স ইনস্টিটিউটের এক বিজ্ঞানী বললেন, হতে পারে রোগপ্রতিরোধে অক্ষম কোনও ব্যক্তির শরীরে এই বিবর্তিত রূপটি তৈরি হয়েছে। হতে পারে সেই ব্যক্তি এইআইভি-তে আক্রান্ত। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিরাট সংখ্যক মানুষ তো এইআইভি-তে জর্জরিত। বলা হচ্ছে, সংখ্যাটা ৮.২ মিলিয়ন। যা পৃথিবীতে সর্বাধিক। বেটা ভ্যারিয়েন্ট, যা কিনা গত বছর বাজারে এল, সেইটিও ওই এইআইভি রোগীর শরীরে জাত বলে মনে করছেন অনেকে। বেটা-র পর, বাপকা বেটাকে নিয়ে এখন মহাসমস্যা সংক্রমিত।
কতটা সংক্রামক?
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তত ১০০ জন এই নয়া করোনা আক্রান্ত বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। নতুন সংক্রমণে সে দেশে আপাতত সবচেয়ে প্রভাবশালী বলা হচ্ছে এটিকেই। আরও স্পষ্ট হিসেবও রয়েছে। পিসিআর পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে জোহানেসবার্গ সহ দক্ষিণ আফ্রিকার রাজ্যে ৯০ শতাংশ নতুন সংক্রমণ এই নয়া ভ্যারিয়েন্ট ( এই তথ্য দিচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন সিক্যোয়েন্সিংয়ের দুটি ইনস্টিটিউট চালানো বায়ো-ইনফরম্যাটিক্সের অধ্যাপক তুলিও দি ওলিভেইরা)। তাদের প্রতিবেশী বোতসোয়ানায় সোমবার জনা চারকের দেহে মিলেছে এই ভাইরাস। এঁরা আবার পুরোপুরি প্রতিষেধকপ্রাপ্ত। কোয়ারেন্টিনে থাকা আরেক জনের শরীরেও এর উপস্থিতির খবর হাজির।
কতটা ভয়ের?
এখনও সে কথা বলার সময় আসেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এখনও পর্যন্ত ১০০ জনের কম মানুষের দেহে পাওয়া গিয়েছে এই ধরনটি। সময় লাগবে হন্তারক অতিথিকে পুরোপুরি জানতে, বুঝতে। এখন বাজারে যে সব ভ্যাকসিন রয়েছে, সেগুলি কতটা এর বিরুদ্ধে কার্যকর, তার তল পেতেও প্রয়োজন ওই টাইম-ই। ভাইরাসের বিবর্তন হতে থাকে, সেটাই স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রে সেই বিবর্তন দুর্বল করে তোলে তাকে। আবার উল্টোটাও হয়।
কী হবে পরবর্তী পদক্ষেপ?
শুক্রবার হু বৈঠক করেছে। তাতে B.1.1.529-এর আপাদমস্তক আলোচনা হয়েছে। এই নয়া করোনাকে ভ্যারিয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট নাকি ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন ঘোষণা করা হবে, সে সম্পর্কে কথাবার্তা হয়েছে। যদি তা হয়, তবে গ্রিক বর্ণ ধার্য হবে এর জন্য, হু-র নামকরণের কায়দা অনুসারে। হবে পারে “nu.”।
ইজরায়েলে নয়া করোনা
ইজরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানাচ্ছে, পূর্ব আফ্রিকার মালাওয়াই থেকে আসা এক ব্যক্তির দেহে তারা নয়া করোনা পেয়েছে। এটাই সেখানে এর প্রথম কেস। শুক্রবার সরকারি তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে খবর। আরও দু'জনকে নতুন ধরনে আক্রান্ত সন্দেহে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এই তিন জনই প্রতিষেধক নেওয়া। তবে প্রতিষেধকের সবিস্তার তথ্যে নজর দেওয়া হচ্ছে।
ভ্যাকসিন দিয়ে যে করোনার কাম পুরো তামাম হবে না, সে কথা বিজ্ঞানীরা বলেছেন ইতিমধ্যেই। ভ্যাকসিন করোনার দংশনশক্তি কমিয়ে দেবে। মৃত্যুর থেকে টেনে সরাবে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক সেইটা করতে পারলেই তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।