Advertisment

Explained: 'রাজহাঁসের' বুকে পুতিনের তির, বন্ধ বিদ্রোহী চ্যানেল, জানেন কী ভাবে?

রেন টিভি যুদ্ধবিরোধিতার বার্তা দিতে থাকল, পুতিনের গায়ে তা ফোসকা ফেলল বড় বড়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Natalia Sindeyeva

সরকারের বিরোধিতা করে রুশ টেলিভিশন চ্যানেল টিভি রেন (TV Rain)-এর তার মাথায় পুতিনের প্রহার পড়েছে।

সংবাদ ও স্বাধীনতা। মুদ্রার দুটি পিঠ। কিন্তু এক পিঠ থেকে স্বাধীনতা শব্দটা ঘষে তুলে দেওয়ার চেষ্টা কম হয় না। যার হাতে ক্ষমতা, লঙ্কায় যে গিয়ে রাবণ হয়ে যায়, সে-ই এই কাজটি করে থাকে। ইতিহাস তা-ই বলছে। কর্তার ভজনা না করে শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমের আর কিছুই করার থাকে না বোধ হয়। না-হলে যে খাঁড়া নেমে এসে ঘাড় থেকে মুন্ডুটাকে আলাদা করে দেবে। মুন্ডু গেলে খাওয়ার কোনও সুযোগ থাকবে না। সাম্যবাদের 'সাংঘাতিক' কথাটা থিয়োরি দিয়ে প্রথম লিখেছিলেন কার্ল মার্ক্স।

Advertisment

রাইনল্যান্ড পত্রিকায় সম্পাদক ছিলেন তিনি প্রথম জীবনে। কিন্তু রাষ্ট্রের গায়ে কলম দিয়ে আঁচড় কেটে এমন কোপে পড়লেন যে, কাগজের ঝাঁপ বন্ধ হল। আর্থিক ভাবে জীবনে আর কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি মার্ক্সসাহেব, কিন্তু তা বলে তাঁর কলম, যা সত্যিকারের একটি বন্দুকই বটে, 'গুরুম' করে গিয়েছে আমৃত্যু। শুধু কার্ল মার্ক্স নন, এ তালিকা বিরাট, দেশ-কাল নিরপেক্ষ। নয়া সংযোজন মার্ক্সের বিপ্লব-কথার প্রথম সফল রূপকার যিনি, সেই লেনিনের দেশে। সরকারের বিরোধিতা করে রুশ টেলিভিশন চ্যানেল টিভি রেন (TV Rain)-এর তার মাথায় পুতিনের প্রহার পড়েছে। বন্ধ হয়েছে এই চ্যানেল।

এবং বন্ধের ফতোয়া পাওয়ার পরও প্রতিবাদের পথে ছিল তারা। গত সপ্তাহে এই চ্যানেলের কর্মীরা পদত্যাগ করেন লাইভে। সিগনাল নিভে যাওয়ার আগে বার্তা দেওয়া হয়েছে, নো টু ওয়ার-- যুদ্ধ চলবে না। এখন আপনার মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন আমরা এই চ্যানেলটি নিয়ে এত কথা বলছি। এমন তো কতই হয়! আসলে, রেন টিভি ছিল পুতিন সরকারের নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত একমাত্র চ্যানেল ছিল, মানে এক ও অদ্বিতীয়, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ।

আরও পড়ুন Explained: ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস রাশিয়ায় ‘মৃত’, এবার কী করবে পুতিনের দেশ?

শুরুটা কী করে

২০১৫ সাল, টিভি রেন তাদের পঞ্চম জন্মদিনটি পালন করে রক কনসার্টে। প্রচারের আলো যেন শুষে নেয় অনেকটা। কারণ সেই কনসার্ট প্রতিবাদের প্রতীকের মতো বাজছিল। শ্রোতাদের ভিড় নিরাশ করেনি। তাদের কুর্নিশ জানায় সঙ্গে সঙ্গে, স্বাধীন সাংবাদিকতার দিকে সবুজ ঝান্ডাটা তুলে দেয় আম-জনতা।

না, এই চ্যানেলটি ক্ষমতার দিকে চোখ তুলে সত্যিটা বলার জন্য জন্ম নেয়নি। এটি প্রাথমিক ভাবে একটি লাইফস্টাইল সাংস্কৃতিক চ্যানেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই চ্যানেল সম্পর্কে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র বলছে, আলেজান্দার ভিনোকুরভ এবং নাতালিয়া সিন্দেইয়েভা, ২০০৮-এ সদ্য বিবাহিত দম্পতি, জীবন কাটছিল খুশির নদীর পাশে, তাঁরাই ঠিক করলেন একটি স্বাধীন টেলিভিশন চ্যানেল তৈরি করবেন। রাশিয়ার রোজকার জীবন ও আচরণ, সংস্কৃতির নানা দিক যে চ্যানেলের পর্দায় ফুটে উঠেবে। থাকবে গ্ল্যামারের কথাবার্তা, তাজা খবর।

আরও পড়ুন Explained: শেয়ার বাজারে বড় পতনের কারণ কীভাবে লুকিয়ে তেলের ভিতর, জানেন?

ভিনোকুরভ ছিলেন একটি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের মুখিয়া। সিন্দেইয়েভা একজন নৃত্যশিল্পী। চাইছিলেন সাফল্য, চাইছিলেন খ্যতিযশ-- ভিনোকুরভের অর্থ আর তাঁর শিল্পবোধ এই দুইয়ের মিশেলে রাশিয়ায় আকাশে ডানা মেলে দিল রেন টিভি। মানুষের মনের, মানুষের মেধার, মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষার স্বাভাবিক ধর্মই হল খোলা আকাশে ওড়া। রাশিয়ার রিংটোনটা তখনও 'কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে', যদিও একটু একটু করে যেন মুক্তির দিকে ঝুঁকছিল। আর মুক্তির স্বাদটা উপভোগ করল এই চ্যালেন। সত্যি খবরটা করতে থাকল। যদিও তখনও বিদ্রোহী তকমা জোটেনি কপালে। কারণ সেই শুরুর সময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ, তিনি আধুনিকতার হাওয়া লাগাতে চাইছিলেন রুশ বাতাসে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কেজিবির প্রাক্তন দাপুটে ভ্লাদিমির পুতিন।

আরও পড়ুন Explained: কী এই NATO, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে ইউক্রেনের যোগদান নিয়ে কেন ভীত রাশিয়া?

কিন্তু ২০১২ সালে পালাবদল, মেদভেদেভকে সরিয়ে দেওয়া হল। পুতিন হলেন প্রেসিডেন্ট। চ্যানেল সম্পর্কিত তথ্যচিত্র বলছে,পরিবর্তনের যে হাওয়াটা উঠেছিল, তা মুছে দেওয়াই যেন প্রধান কাজ হয়ে উঠল এর পর পুতিনের জীবনে। ওই ডকুমেন্টরির দৃশ্য থেকে দৃশ্যে বলা হয়েছে, পুতিনের সঙ্গে কী ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন অঙ্গাঙ্গী হয়ে উঠেছিল, সেই কথা। 'আমি বুঝতে পারছিলাম কী ভীষণ অন্যায় আমাদের চারদিকে ঘটে চলেছে। যা আমি আগে কোনও দিন দেখিনি।' বলছিলেন সিন্দেইয়েভা। ফলে তাদের চ্যানেল প্রোপাগান্ডা নয়, সরকারের তাঁবেদারি নয়, সত্যি কথাটা বলতে শুরু করল আরও গর্জনে। এবং যা হওয়ার তা-ই হল, রাষ্ট্র তাদের তাক করে কালাশনিকভ তুলল।

একের পর এক আঘাত

প্রতিবাদ করে তারা হেডকোর্টার খোয়ালেন। বার করে দেওয়া হল সেখান থেকে। কিন্তু সিন্দেইয়েভাদের বাড়িতেই অফিস করে চালানো হচ্ছিল চ্যানেল। না, নিজেদের অবস্থান থেকে না সরে। সংখ্যালঘুদের হয়ে কথা বলা, সে রূপান্তরকামীই হোন বা খেটে খাওয়া দরিদ্রজন, নীতি থেকে তারা সরবে না কিছুতেই।

২০২০ সালে গিয়ে সিন্দেইয়েভার সব টাকা শেষ হয়ে গেল। তবুও মনের জোরে, আর জোগাড়ের জোরে চলছিল চ্যানেল। ২০২১ সালের অগস্টে রাশিয়ার ন্যায়বিচার মন্ত্রক মারাত্মক একটি ঘোষণা করে বসল, বলল-- রেন টিভি বিদেশের চর। সিন্দেইয়েভা পাল্টা দিলেন, বললেন, তাঁরা স্বচ্ছ, চাদরে কোনও কালির ছিটে নেই। বললেন, চ্যানেলে অর্থ-বিনিয়োগের যে কাগজপত্র রয়েছে তাতে কোনও জল নেই। ১১ বছর ধরে একটি দায়িত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের কাজ করে চলেছে রেন টিভি, তিনি বললেন। কিন্তু কে শুনবে তাঁদের কথা। ধর্মের কথা চোর শুনবেই বা কেন!

আরও পড়ুন Explained: ইউক্রেনের ফার্স্ট লেডি ওলেনা জেলেনস্কার রূপে ও গুণে মুগ্ধতার স্রোত, কেন জানেন কি?

এর পর পুতিনের ইউক্রেন হামলা কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতল। রেন টিভি যুদ্ধবিরোধিতার বার্তা দিতে থাকল, পুতিনের গায়ে তা ফোসকা ফেলল বড় বড়। শেষে গত সপ্তাহে যে কাজটি তারা করল, তার পর চ্যানেলটিকে আর 'এয়ারের' সুযোগ দেওয়া মানে আত্মহত্যা করা। হয়তো ভাবলেন পুতিন। রেন টিভির সোয়ান লেক-কাণ্ড বলা হচ্ছে যে ঘটনাটিকে। সোয়ান লেক কী? চাইকোভোক্সির অমর সুর নির্মাণ। রূপকার্থে, রাশিয়ায়-- অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়। গত সপ্তাহে চ্যানেলের পর্দায় দেখা গেল সাদা-কালো রাজহাঁস নৃত্যরত, আর নেপথ্যে বাজছে সোয়ান লেক। না, তার আর পর নেই।…

'রাজহাঁসের' বুকে পুতিনের তির বিঁধে, কিন্তু তার উড়ালটা অবিস্মরণীয়।

Dozhd Natalia Sindeyeva Vladimir Putin
Advertisment