লাহোর দুর্গে এতদিন তো শোভা পাচ্ছিল। কিন্তু আচমকাই মহারাজা রঞ্জিৎ সিংয়ের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শিখ সাম্রাজ্যের এই রাজার ৯ ফুটের ব্রোঞ্জ মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনায় পাকিস্তানে ব্যাপক শোরগোল। জানা গিয়েছে, রিজওয়ান নামে তেহরিক-এ-লাব্বাইক পাকিস্তানের মতো উগ্র ডানপন্থী দলের এক সদস্য এই মূর্তির বাঁ হাত ভেঙে সেটা ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। ঘোড় সওয়ার মূর্তি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর অনেকেই যুবককে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়, বাকিরাও তাঁকে বাধা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
এই ভাঙচুরের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাইরাল হওয়ার পর পাক মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরি টুইটারে ঘটনার তীব্র নিন্দা করে লেখেন, অত্য়ন্ত লজ্জাজনক এই ঘটনা। কিছু অশিক্ষিতের জন্য পাকিস্তানের ছবি বিশ্বে খারাপ হচ্ছে। পাক সংবাদমাধ্যম ডন-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভাঙচুরকারী গ্রেফতার হয়েছে। লাহোরের সিটি পুলিশের অফিসার গুলাম মাহমুদ ডোগার বলেছেন, কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক হেরিটেজে এমন আক্রমণ থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে সে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর কেমন অসহিষ্ণুতা এবং অসম্মানিত করা হচ্ছে। পাকিস্তান সরকার কি এই ধরনের হামলা আটকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এরপর পাক সরকারের কাছে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকে নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং সংখ্যালঘুদের কল্যাণের আবেদন করা হয়।
কিন্তু বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য নিয়ে অসন্তুষ্ট হয় পাক বিদেশ দফতর। এই ধরনের মন্তব্যকে উস্কানিমূলক, দ্বিচারিতা বলে উল্লেখ করা হয়। বরং ভারতে যেভাবে সরকারি মদতে সংখ্যালঘুদের উপর বৈষম্য হয় তার নিন্দা করে পাক সরকার।
রঞ্জিৎ সিং এবং লাহোর
মহারাজা রঞ্জিৎ সিং (১৭৮০-১৮৩৯) ১৭৯৯ সালে লাহোর দখল করেন। তার আগে শিখ, হিন্দু এবং মুসলিম প্রভাবশালীরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর সেই সময় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উন্নত শহর ছিল। মৃতপ্রায় মোঘলরা তখন প্রজাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল। আফগান দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে তখন শিখ-হিন্দু ও মুসলিমরা রঞ্জিৎ সিংয়ের শরণাপন্ন হন। জোর করে কর আদায় করা হত তাঁদের থেকে।
রঞ্জিৎ সিং শান্তি ও সুরক্ষা দিতে পেরেছিলেন লাহোরবাসীকে। লাহোরের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনেন তিনি। এরপর ১৮০১ সালে নিজেকে পাঞ্জাবের রাজা ঘোষণা করেন তিনি। শিখ ছাড়াও অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন তিনি। মোঘল সম্রাট আকবরের তৈরি লাহোর দুর্গ সংস্কার, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, তারপর সেই দুর্গের একাংশ বসতবাড়ি হিসাবে ব্যবহারের জন্য খুলে দেন তিনি।
আরও পড়ুন তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের গলায়-গলায় দোস্তি, কী ভাবে?
পাকিস্তানেও সম্মানিত শিখ মহারাজা
উত্তর-পশ্চিম ভারতে বিরাট সাম্রাজ্যের সম্রাট পাঞ্জাবের পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন। এক দশক আগের কথা, পাকিস্তানি ভিডিও ব্লগাররা মহারাজার উজ্জ্বল তৈলচিত্র ইউটিউবে পোস্ট করেন। রঞ্জিৎ সিংয়ের ধর্ম নিরপেক্ষ মূল্যবোধকে তুলে ধরেন তাঁরা। বহু হিন্দু-মুসলিম মন্ত্রীকে রাজসভায় নিয়োগ করা, বিখ্যাত সুনহেরি মসজিদকে মুসলিমদের হাতে সঁপে দেন তিনি, যা আগে শিখ দস্যুরা গুরদ্বারায় রূপান্তরিত করেছিল। সেটি সংস্কারও করেন।
কিন্তু সময় পাল্টেছে। লাহোরের রূপকার রঞ্জিৎ সিং এখন সেখানেই নিন্দিত। কিছু উগ্র ধর্মান্ধ মহারাজার ব্রোঞ্জ মূর্তি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে একজন মূর্তির একটি হাত ভেঙে দেয়। পুলিশকে পরে সে বলে, রঞ্জিৎ সিংয়ের মূর্তি তৈরি করা উচিত হয়নি। তারণ তিনি নিজের শাসনকালে মুসলিমদের উপর খুব অত্যাচার করেন। মঙ্গলবারের ঘটনা এই নিয়ে তৃতীয়বার হল।