বন্য়ায় বিধ্বস্ত অসম। বন্য়ায় বানভাসি অসমে প্রাণ কেড়েছে ৭৩ জনের। বন্য়ার জেরে রাজ্য়জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্য়ান ও ব্য়াঘ্র সংরক্ষণের ৮৫ শতাংশই জলের তলায় চলে গিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে জাতীয় উদ্য়ানে বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখেন অসমের মুখ্য়মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। এখনও পর্যন্ত ১২৫টি জন্তুকে উদ্ধার করা হয়েছে। বন্য়ার জেরে মৃত্য়ু হয়েছে গণ্ডার, হরিণ ও বন্য় শূকর-সহ ৮৬টি জন্তুর।
তবে, ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য় বছরে বন্য়া অপরিহার্য বলেই মনে করা হয়। কিন্তু কেন? কাজিরাঙা ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) নেপথ্য়ে বন্য়ার ভূমিকা কী? তারই বিশদে ব্য়াখ্য়া করা হল এখানে...
কাজিরাঙা ইকোসিস্টেমে বন্য়ার ভূমিকা ঠিক কী?
অসম এমনিতেই বন্য়া প্রবণ এলাকা। এর ব্য়তিক্রম নয়, ১ হাজার ৫৫ বর্গ কিমির কাজিরাঙা জাতীয় উদ্য়ান ও ব্য়াঘ্র সংরক্ষণ। একদিকে ব্রহ্মপুত্র নদী, অন্য়দিকে কার্বি অ্য়াংলং পাহাড়, এই দুইয়ের মধ্য়িখানে যেন স্য়ান্ডইউচের মতো রয়েছে কাজিরাঙা উদ্য়ান। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাজিরাঙা বাস্তুতন্ত্রের ভালর জন্য়ই বন্য়া হওয়াটা জরুরি।
কাজিরাঙা জাতীয় উদ্য়ান ও ব্য়াঘ্র সংরক্ষণের ডিরেক্টর পি শিবকুমার জানিয়েছেন, ''এটার অবস্থান নদী তীরবর্তী, শক্ত মাটির উপর এর অবস্থান নয়। ফলে, কাজিরাঙা বাস্তুতন্ত্র জল ছাড়া টিকতে পারবে না''। বন্য়ার ফলে কাজিরাঙার জলাশয়গুলি যেমন ফের ভরাট হতে পারে, তেমনই তৃণভূমি, বনগুলি ভালভাবে সতেজ থাকে।
বন্য়ার ফলে কাজিরাঙায় কি কোনও সমস্য়া হতে পারে?
সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ রিহ্য়াবিলেটেশন অ্য়ান্ড কনজার্ভেশনের প্রধান রথীন বর্মনের কথায়, ''আগে আগে ১০ বছরে একটা ভয়াল বন্য়া হত। এখন প্রতি বছর প্রায় হয়''। তাঁর কথায়, জলাবদ্ধ অঞ্চলে ব্য়াপক হারে বননিধন বা বাঁধ দিয়ে ব্য়াপক হারে জল ছাড়ার জেরে এটা হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও হতে পারে যে প্রতি বছর বন্য়ার হার বাড়ছে।
২০১৮ সাল বাদে, ২০১৬ ও ২০২০ সালের মধ্য়ে ব্য়াপক বন্য়া হয়েছে, যার ফলে শয়ে শয়ে জীবজন্তুর মৃত্য়ু হয়েছে এবং শয়ে শয়ে জীবজন্তু জখম হয়েছে। বন্য়ার সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে খাপ খাইয়ে নেয় জীবজন্তুরা। কিন্তু জলস্তর একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছোলে, জীবজন্তুরা কার্বি অ্য়াংলং পাহাড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়।
অতীতে, কাজিরাঙা ও কার্বি অ্য়াংলং একই অঞ্চলের মধ্য়ে ছিল। কিন্তু এখন সেখানে যেতে হলে উদ্য়ান সংলগ্ন ব্য়স্ততম জাতীয় সড়়ক পেরোতে হয় জন্তুদের। কাজিরাঙা করবেট ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর অ্য়ান্ড ভেটেরিনারি অ্য়াডভাইসর নবীন পাণ্ডের কথায়, ''বছরের পর বছর ধরে হাইওয়ে পারাপারের জন্য় দুঃসহ হয়ে পড়ছে। ৯টি বন্য়প্রাণী করিডরের কয়েকটা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে''। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান ও আনুষাঙ্গিক কাঠামো যে হারে বেড়েছে, তার ফলে সমস্য়া হয়েছে।
এরফলে, উদ্য়ানের বাইরে যখনই জূবজন্তুরা বেরোয়, হয় হাইওয়েতে গাড়ির ধাক্কায় তাদের মৃত্য়ু হয়, তা না হলে, চোরকারবারীদের হাতে পড়ে তারা। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে, কড়া নজরদারির জেরে এ ধরনের ঘটনা কম হচ্ছে। যারা পার্কের মধ্য়েই থাকে, বন্য় জন্তুরা হয় ডুবে মারা যায় কিংবা জলের তলায় ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে যায়।
আরও পড়ুন: রাজস্থান সংকট: কীভাবে অধ্যক্ষের এক চিঠি বদলে দিল সংখ্যাতত্বের খেলা
সংলগ্ন গ্রামগুলিতে কী প্রভাব পড়ে?
পার্ক সংলগ্ন ৭৫টি গ্রামের মধ্য়ে ২৫টিতেই বন্য়ার প্রভাব পড়ে। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্য়ানের ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ অফিসার রবীন্দ্র শর্মা জানিয়েছেন, ''বন্য়ার সময় গণ্ডারের বাচ্চারা তাদের মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। বাঘেরা সাঁতরে পার হয়ে বাড়ির মধ্য়ে ঢুকে পড়ে। হরিণরা গ্রামের মধ্য়ে ঢুকে পড়ে''। এর জেরে, মানুষ বনাম জন্তু বিবাদ প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়।
বন্য়ায় আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে কী করা হয়?
বন্য়ার এক মাস আগে সবরকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়। উদ্য়ান কর্তৃপক্ষ সর্বক্ষণ সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের থেকে আপডেট নিতে থাকেন। জলস্তরের সীমা সর্বদা নজরে রাখা হয়। ডা. পাণ্ডে জানালেন, বন্য়ার আগে বাড়ি বাড়ি ভ্য়াকসিনেসন করা হয়। তাছাড়া, বন্য়প্রাণীদের কেউ যাতে আঘাত না করেন, সে ব্য়াপারে জনমানসে সচেতন করা হয়। যখন বন্য়া হয়, তখন ৩৭নং জাতীয় সড়ক সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
কাজিরাঙায় কৃত্রিম পার্বত্য় অঞ্চল কতটা উপযোগী?
বন্য়ার সময় জীবজন্তুরা যাতে সুরক্ষিত স্থানে থাকতে পারে, সেজন্য় পার্কের মধ্য়ে কৃত্রিম পার্বত্য় অঞ্চল (হাইল্য়ান্ডস) তৈরি করা হয়েছে। তবে অনেকের মতে, এটা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। যে ৩৩টি হাইল্য়ান্ডস বানানো হয়েছে, তা কাজিরাঙায় সব জীবজন্তুর থাকার জন্য় যথেষ্ট নয়।
তাহলে সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্য়ানিমেল করিডরের নিরাপত্তায় আরও জোর দেওয়া দরকার। পাশাপাশি কার্বি পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার জায়গা আরও সুরক্ষিত করা দরকার। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৭নং জাতীয় সড়কের উপর ৩৫ কিমি লম্বা উড়ালপুল বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। শিবকুমারের কথায়, ''৩৫ কিমি লম্বা উড়ালপুল বানানো সময়সাপেক্ষ। সুতরাং, এখন আমাদের দেখতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে এই নির্মাণকাজ করা যায়, যাতে জীবজন্তুদের কোনও সমস্য়া না হয়''। এদিকে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে পার্কের দক্ষিণ সীমানা বরাবর এলাকায় সব ধরনের খনন কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
Read the full story in English