শেয়ার বাজার এবং টাকায় যেন করুণ রসের চরম ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। সোমবার সেনসেক্স এবং নিফটি একেবারে মুখ নিচু করে নীচের দিকে দৌড়ে যায়। সেনসেক্স ১,৪২২ পয়েন্ট কমে পৌঁছয় ৫২,৮১১.২৩-এ। এবং নিফটি ৪০৮ পয়েন্ট কমে পৌঁছয় ১৫,৭৯৩.১৫-এ। এটা বেলা ১২.১৫-র হিসেব। পরে অবশ্য দুটিই একটু বাড়ে। সেনসেক্স ৫২.৯৩৩.৫৭। শুক্রবার বাজার বন্ধ হয়েছিল ৫৪,২৬৫.২২-তে। নিফটি পৌঁছয় ১৫,৮০০.৩০-এ। শুক্রবার বাজার বন্ধের সময় যা ছিল ১৬,২০১.৮০। আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতির হিসেব সামনে আসার পর এই বিরাট পতন। চার দশকের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সেখানে। হার ৮.৬ শতাংশে পৌঁছেছে। এর ফলে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ফের সুদের হার বাড়াবে সেই সম্ভাবনা প্রবল ভাবে দেখা দিয়েছে। যাতে শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি পুঁজি আরও বেরিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে, আর সেই আশঙ্কাতেই এ দিনের এই পতন। ডলারের নিরিখে টাকার দামও পড়েছে। ৭৮ -এর নীচে নেমে গিয়েছে টাকা। ডলার পিছু টাকা পৌঁছেছিল ৭৮.২৮-তে।
কেন এই হাল, তার বিস্তারিত
এ দিন আমেরিকার যে মুদ্রাস্ফীতির হার সামনে এসেছে, সেটা মে মাসের মুদ্রাস্ফীতির হিসেব। ৪০ বছরে যা সর্বোচ্চ। সে দেশের কনজিউমার প্রাইজ ইনডেক্স (সিপিআই) ৮.৬ শতাংশ হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএস লেবার ডিপার্টমেন্ট। সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, খাবার এবং জ্বালানি, যে দুটি কোনও পরিবারের খরচের বড় অংশ, মার্কিন মুলুকে তা বেড়ে গিয়েছে গত এক বছরে, দ্রুত গতিতে। জ্বালানির দাম বেড়েছে ৩৪.৬ শতাংশ। যা ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। ফুড ইনডেক্স বেড়েছে ১০.১ শতাংশ। ১৯৮১ সালের পর যা ছাড়াল ১০ শতাংশ-কে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ফেডারেল রিজার্ভ তাদের সুদ বাড়ানোর অস্ত্রটাই বার করবে। কারণ, মুদ্রাস্ফীতিতে লাগাম দেওয়ার লক্ষ্যে সেটাই তো ব্রহ্মাস্ত্র।
ইতিমধ্যে মার্চের মাঝামাঝি দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মে মাসের শুরুতে দশমিক ৫০ শতাংশ সুদের হার বাড়িয়েছে তারা। অনেকেই বলছেন, আরও ৫০ বেসিসপয়েন্ট বাড়াবে ফেডেরাল রিজার্ভ, তা ৭৫ বেসিসপয়েন্ট হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ফলে আমাদের দেশের সঙ্গে মার্কিন সুদের হারের গ্যাপ-টা বাড়বে, আমেরিকার বাজারে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ এই ভাবনা থেকে এ দেশের শেয়ার বাজার থেকে ফান্ড বেরিয়ে যাচ্ছে, আরও যাবে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ বেরবে। যা শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ কিছু দিন তো হয়েই গেল, এবার আরও বড় আশঙ্কা, এবং সেইটি থেকেই শেয়ারের এই পতন।
আরও পড়ুন Explained: জিএসটি-র ঊর্ধ্বগতি জারি, কেন বাড়ছে কর আদায়, অর্থনীতিতে কি এর ফলে সুবাতাস?
কেন টাকার দাম পড়ল?
উপরের কাহিনিটার কারণেই টাকার দাম পড়েছে। ফলে ওই কাহিনিটাকেই বাড়াতে হবে। এখানে একটু বলে নিই যে, কয়েক মাস ধরেই আমাদের শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি মূলধন বেরিয়ে যাওয়ার ঝোড়ো হাওয়াটা লেগেই রয়েছে। জুন থেকে এই হিসেবটা ১৮ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। মানে, এই পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে গিয়েছে। আর জানুয়ারি থেকে ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টারদের এই আউটফ্লো-র পরিমাণ ২.৪০ লক্ষ কোটি টাকা। এটাই টাকার উপর চাপ তৈরি করেছে। ডলারের তুলনায় তাকে নীচে নামিয়ে দিচ্ছে আরও।
যদিও আরবিআইকে ডলার বিক্রি করে এই দামের পতন রোখার চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। এই পতনের ফলে আমদানির খরচ বাড়বে, আর রফতানি আকর্ষণীয় হবে। কারওর সর্বনাশ হলে তো কারওর পৌষমাস হবেই। ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি বা এফওএমসি-র বৈঠক দোড় গোড়ায়, ১৫ জুন। তারা ভাল মাত্রায় সুদের হার বাড়াবে, এখন আরবিআই কী করবে, সেই দিকে নজর রাখাটা জরুরি। এর আগের বার ফেডেরাল রিজার্ভ সুদের হার যে দিন বাড়াল, তার আগে হঠাৎ বৈঠকে আরবিআই তাদের সুদের হার বাড়ায়। আর ৮ জুন আরবিআই তাদের সুদের হার বাড়িয়েছে ৫০ বেসিস পয়েন্ট।
আরও পড়ুন Explained: ব্যাঙ্কঋণে বাড়তে পারে ইএমআই, আরবিআইয়ের রেপো রেট বৃদ্ধি বলছে সেকথাই, কী ভাবে?
পরিস্থিতি কি শোধরাবে?
এটা অনেকটা নির্ভর করছে আমেরিকার সুদের হার বৃদ্ধি কবে থামায়, তার উপর। বাজার আবার নিজের গতিতে ফিরবে তখনই, যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরবেন। ফলে এখন এখানকার যাঁরা বিনিয়োগ করে বসে রয়েছেন, তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্যং দেহি। রুপোলি রেখাও রয়েছে। সেটি হল, ভারতের শিল্প উৎপাদন এখন ভাল মাত্রায় হচ্ছে। এপ্রিলের শিল্পসূচক (ইনডেক্স অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন বা আইআইপি) এক লাফে বেড়ে পৌঁছেছে ৭.১ শতাংশে। যা বলছে ভারতের অর্থনীতি ফিরছে নিজের পুরনো ঘরে। তবুও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে এখন সতর্ক হতে হবে। যে সব শেয়ার থেকে আগামীতে ভাল কিছুর প্রবল ও সুনিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সব শেয়ারেই বিনিয়োগ সীমায়িত করতে হবে।
তবে, দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের এসআইপিগুলি বন্ধ করার কোনও দরকার নেই। যেমন চলছে তেমনই চালিয়ে যেতে পারেন সেগুলি, সুসময়ের দিকে তাকিয়ে। এমনই বলছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।