গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী পাতিদার, পাঞ্জাবে দলিত। একই পথে বিজেপি ও কংগ্রেস। প্রান্তিকের প্রগতির নতুন যুগ শুরু হল কি এ দেশে? এই আলোচনা অতল থেকে উঠে এসেছে উপরে। নতুন করে দলিত চর্চার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তাই। 'আমি পুনর্জন্ম চাই না। কিন্তু যদি আমার পুনর্জন্ম হয়, তা হলে অস্পৃশ্য হিসেবে জন্ম নিতে চাই। কারণ, আমি তাঁদের দুঃখ-যন্ত্রণার শরিক হতে চাই, যে অপমানের তকমা তাঁদের উপর সাঁটা, তা বুঝতে চাই। নিজের মুক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে তাঁদের দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে চাই।' ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় এমনটাই লিখেছিলেন মহাত্মা গান্ধি। দেশের একাংশের মানুষকে আনটাচেবিলিটি বা অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্ত করতে গান্ধির লড়াই আজ মিনার, যা মাঝে মাঝে ঘুরে দেখতে যাওয়া হয়, কিন্তু গান্ধির পথে এক-দু'পাও হাঁটেনি ভারত, আজও। না হলে এ রাজ্যে ভোট প্রচারে এসে অমিত শাহদের প্রান্তিক মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আসনপিড়ি হয়ে মহাভোজ খেতে হত না। আমি তোমাদেরই লোক, এই মরিয়া চেষ্টা-- তিলমাত্র অপ্রয়োজনীয় ছিল তা হলে। ধর্মজাতপাতের ভারত, বিভাজনের মহাকুম্ভ যেন, একদিন ট্রেনে একজন এমনটাই বলেছিলেন, কথাটা মনে লেগে আছে। হ্যাঁ, সেই মহাকুম্ভ-স্নান সেরেই এ দেশে রাজনীতি করতে নামতে হয়, এমন আজও রীতি। অনেকের মত, তাতেই মুখ্যমন্ত্রী পদে এই দলিতারোহণ। ভোটের জুজু কম মরাত্মক নয়!
গান্ধির হরিজন, আম্বেদকরের দলিত
গান্ধি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৩৩ সালে, নাম-- হরিজন। হ্যাঁ, গান্ধিজির সৌজন্যেই দলিতদের হরিজন বলা শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে ক্রমে বিতর্কের বিস্ফোরণও হয়েছিল। দলিত বোঝাতে কেন 'হরিজন'? এর বিরুদ্ধে ছিলেন দলিত আইকন বাবাসাহেব আম্বেদকর। ১৯৩৮-এর ২২ জানুয়ারি বম্বে বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করে এই ইস্যুতে কড়া আক্রমণও শানান তিনি। হিন্দু সমাজের তলায় থাকা দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচারিত হয়ে চলা অংশটি, যাঁরা উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ, ফুটছেনও, তাঁরা হিন্দু সমাজভুক্ত, এটাই বোঝাতে হরিজন শব্দটিকে হাতিয়ার করেছিলেন গান্ধি, আর এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে ছিলেন বাবাসাহেব।
তিনি মনে করতেন, দলিত বললে, যে ছবিটা ফুটে ওঠে, এক লহমায় এই অংশের অবস্থানটা যে ভাবে বোঝা যায়, হরিজন শব্দে তা হয় না। আবার হরিজন প্রয়োগে দলিত সমাজের কোনও সুরাহাও হয় না। অস্পৃশ্যই থেকে যান তাঁরা। তা ছাড়া আম্বেদকরের বিচারে গান্ধিজি ছিলেন দলিত বিরোধী । বিবিসি-কে দেওয়া একটি অডিও সাক্ষাৎকারেও মোহন দাস গান্ধির সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন আম্বেদকর। তিনি বলেন, 'ইংরাজি পত্রিকা 'হরিজন'-এ যে ভাবে গান্ধি দলিতের পক্ষে কথা বলেছেন, গুজরাতি পত্রিকায় তিনি পুরো উল্টো গীত গেয়েছেন। সেখানে গান্ধি একজন অর্থোডক্স হিন্দু ছাড়া আর কিছু নন। এমনকি দলিত বিরোধীও।'
দলিতকে হিন্দু সমাজের মূল স্রোতে দেখতে চেয়েছিলেন গান্ধি, আম্বেদকর দলিতের অবস্থানের উন্নতি চেয়েছিলেন, উচ্চবর্ণের সঙ্গে একাসন-- কিন্তু দলিত পৃথক হয়ে রয়ে গিয়েছে, এখনও, তাই তো একজন দলিত, চরণজিৎ সিংহ চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী করে কংগ্রেসকে ভোটের রাজনীতিতে চাপমুক্ত হতে হচ্ছে। পঞ্জাবের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী, এটা আসুমদ্র হিমাচল জেনে গিয়েছে, কারণটাও মোটামুটি চাউর হয়েছে। পাঞ্জাবে মাস পাঁচেক পর ভোট, বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে হারিয়ে দিয়েছে তৃণমূল, যখন করোনা নিয়ে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, এখন পাঞ্জাব পুনর্দখল করার স্বপ্ন পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াছবির মতো দেখছে কংগ্রেস, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল পাঞ্জাবে, তা নেভানোর জন্য দলিত তাস চন্নিই আদর্শ বলে মনে করছে তারা। কারণ, সে রাজ্যে প্রায় ৩২ শতাংশ দলিত।
প্রফেসর সন্তোষ কে সিং, যিনি পাঞ্জাবের জাতিধর্ম নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন, বলছেন, 'যাঁরা এই অঞ্চলের জাতি-ইতিহাস জানেন, তাঁরাই বলবেন এটা পঞ্জাবের জন্য ঐতিহাসিক। একটা মাইলস্টোন। এখানে বড় অংশের মানুষ দলিত, তা সত্ত্বেও, এই দিনটির জন্য তাঁদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হল।' তা ছাড়া, এও শোনা যাচ্ছে, বিজেপি যে ভাবে পাতিদার নেতা ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী করেছে, তাতে এ জাতীয় একটা কিছু না করলে আগামী লোকসভা ভোটের ময়দানে জাতপাতের অঙ্কে সনিয়া-রাহুলরা ন্যূন হয়ে যেতেন। আগে থেকে পরিকল্পনা করে চান্নিতে সওয়ার হয়েছে কংগ্রেস।
পাঞ্জাবের দলিত সংখ্যায় নজর
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, পঞ্জাবে ২ কোটি ৭৭ লক্ষ তফশিলি জাতি-ভুক্ত মানুষ রয়েছেন। অর্থাৎ দলিত রয়েছেন। শতাংশের বিচারে ৩১.৯। এর মধ্যে ১৯.৪ শতাংশ শিখ এবং ১২.৪ শতাংশ হিন্দু। দলিত ভোটের বিচারে হিসেব বলছে, কোনও দলই পুরো দলিতের ভোট পায়নি। ৫ থেকে ৭ শতাংশ ফ্লোটিং ভোট রয়েছে। এই ভোটের উপর অনেকটা নির্ভর করছে সরকারে কার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। শিখ দলিত চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রীকে করে সেই ভোটই পেতে চায় সনিয়ার দল। এমনই বলছেন জলন্ধরের ডিএভি কলেজের প্রফেসর জি সি কল।
শুধু তা-ই নয়, উত্তরপ্রদেশে আসন্ন ভোটে দলিত ভোট বাক্সেও এই সিদ্ধান্তে কংগ্রেসের পক্ষে বার্তা যাবে। আবার, পাঞ্জাবেও বহেনজি মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি এতে নিদারুণ চাপে পড়তে পারে। পাঞ্জাবে ২০১৭-র ভোটে মায়াবতীর ভোট ছিল ১.৫ শতাংশ, ১৯৯২-এ যা ১৯.৭ শতাংশ ছিল। বুঝতেই পারছেন, কোথা থেকে বহেনজি কোথায় নেমেছেন! চান্নি-চালে এই দেড় শতাংশও বহেনজি হারাতে পারেন, আশায় কংগ্রেস।
দলিত-দুনিয়া
দেখা যাচ্ছে দলিতকে খুশি করতে সব দলই মরিয়া। তুষ্টিকরণের বিরুদ্ধে যে বিজেপি, তারাও। বিজেপিকে দলিতের পক্ষে প্রমাণ করতে হবে। এখনও দলিতের পক্ষে, তা প্রমাণ করতে হবে কংগ্রেসকে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের আদত উন্নতি কে কতটা চায়, সে প্রশ্নটাই মূল, উত্তর হাতড়ানো ছাড়া উপায় নেই। আর একটু গান্ধি-আম্বেদকরের প্রসঙ্গে আসি। আগেই বললাম গান্ধির দলিত-প্রিয়তা নিয়ে গোলাগুলি ছুড়েছিলেন আম্বেদকর। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক তোপটি হল,'গান্ধিজি কংগ্রেসকে স্ফীত করতে প্রো-দলিত অবস্থান নিয়েছিলেন। যা আসলে লোক-দেখানো। তিনি দলিতদের সঙ্গে দ্বিচারিতা করেছেন।' গান্ধিকে মহাত্মা হিসেবে তিনি মানেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন আম্বেদকর।
দলিতার্থ
শেষে দলিত শব্দের অর্থে চোখটা ঘুরিয়ে নেওয়া যাক। আসলে এটি সংস্কৃত শব্দ। ধ্রুপদী সংস্কৃতে এই শব্দটির মানে বিভাজন বা ছড়ানো। ঊনবিংশ শতাব্দী সংস্কৃত চর্চায় অর্থবদল হয় কিছুটা। ব্রাহ্মণের মূল তালিকার বাইরে যাঁরা, তাঁদের বলা হতে থাকে দলিত। এই অর্থ থেকেই 'অস্পৃশ্য'-এর জন্ম, মনে করেন ভাষাবিদদের অনেকে। মানবাধিকার কর্মী ও সমাজ সংস্কারক জ্যোতিরাও ফুলে হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্য শ্রেণিকে বোঝাতে দলিত-এর প্রথম প্রয়োগ করেন। আর গান্ধির 'হরিজন'? এল কোথা থেকে? গুজরাতি সাধক-কবি নরহিংস মেহেতার 'বৈষ্ণব জন কো…' ভজন মহাত্মা গান্ধির অতি প্রিয় ছিল, বৈষ্ণব জনই তো হরিজন। অনেকে মনে করেন, তুলসী দাসী রামায়ণ থেকে গান্ধি এই শব্দটিকে ব্যঞ্জনা সহ তুলে এনে ব্যবহার করেন।
অনেক দিন হল দলিত বোঝাতে ব্যবহার করা হয় না হরিজন, তা হয়তো উচিতও নয়। কারণ হরিজন মানে হয়ে গিয়েছে নিচু জন, অস্পৃশ্য মানুষ, এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই শব্দটির বিরুদ্ধে বলেছিল কড়া ভাষায়। পাশাপাশি, নিপীড়িত বোঝাতে দলিত মৌখিক ভাবে ব্যবহার করা হলেও, সরকারি ভাবে তা হয় না। দলিতের বদলে এসসি/এসটি বলা হয়। ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সব রাজ্য সরকারকে এটি ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশিকাও দেয়। যা হোক, সে সময় গান্ধির হরিজন পত্রিকা ব্যপক সাড়া ফেলেছিল, এটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধিজি নিহত হওয়ার পর, গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া সি রাজাগোপালাচারী 'হরিজন' বন্ধের ঘোষণা করেন।
দলিত শিখ মুসলিম হিন্দু ইত্যাদিতে টুকরো টুকরো ভারতের কী হবে? এই বেদানা-দেশের বেদনার দিন শেষ হবে কবে? নির্বাচন ও নির্বাচনী রাজনীতি তার জবাব দিতে পারেনি এখনও।