ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ গোঁত্তা খেয়েছে। ১১ মার্চ শেষ হওয়া সপ্তাহে এই রিজার্ভ ৯.৬৪ বিলিয়ন কমে গিয়েছে। পৌঁছে গিয়েছে ৬২২. ২৭৫ বিলিয়ন ডলারে। এবং এই হ্রাসমানতার কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন, তেলের দাম বৃদ্ধি, শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ গল-গল করে বেরিয়ে যাওয়া, টাকার দামের পতন, ইত্যাদি। এখানে বলতে হবে, দু'বছরের মধ্যে এই ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের সবচেয়ে বড় পতন এটা। এর আগে ২০ সালের ২০ মার্চ শেষ হওয়া সপ্তাহে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ, যাকে সংক্ষেপে ফরেক্স বলা হয়, কমেছিল ১১.৯৮ বিলিয়ন ডলার। যা হয়েছিল কোভিডের আতঙ্কে।
ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ কী?
কোনও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে এই রিজার্ভ বা সঞ্চয় থাকে। ভারতের ক্ষেত্রে যা করে আরবিআই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বিদেশি মুদ্রা, প্রধানত ডলারের বিশাল এক ভাণ্ডার তৈরি করে রেখেছে সঞ্চয় হিসেবে। পৃথিবীর নানা ব্যাঙ্কে তা গচ্ছিত রেখেছে তারা। রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়েছে সোনাও। ধরা যাক, বিদেশি অর্থ যদি ভারতে বেশি আসে, বিদেশি বিনিয়োগ যদি বেশি হয়, তা হলে আরবিআইয়ের কাছে ডলারের ভাণ্ডার বাড়বে। যদি উল্টোটা হয়, মানে বিনিয়োগকারীরা চলে যান, তা হলে ডলারের পরিমাণ কমে যাবে। এ ছাড়া যদি ভারতকে আমদানি করতে গিয়ে বেশি খরচ করতে হয়, তা হলেও ডলার কমবে। উল্টোটা হলে, ফলও উল্টো রকম হবে। এখন যেমন তেলের দাম বেড়ে গিয়েছে। সে জন্য ডলার খরচ বেশি হচ্ছে। কোভিডের প্রথম দিকটায় তেলের দাম কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছিল। সোনার দাম বেড়েছিল। ২০-র মার্চে ধাক্কা লাগলেও তার পর চড়েছিল ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ। ২০২১ অর্থবর্ষে তো এই রিজার্ভ রেকর্ড করে ফেলে। সঞ্চয়ে ১০১.৫ বিলিয়ন যোগ হয়েছিল ওই সময়ে।
রিজার্ভ হ্রাসের কারণের গভীরে
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে টাকার দামে, অপরিশোধিত তেলের দামও চড়েছে অনেকটা। একে তো কোভিড পরবর্তীতে চাহিদা বৃদ্ধি হয়েছে দ্রুত গতিতে, কিন্তু জোগান তো সেইমতো বাড়ানো যায়নি, ফলে তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। উত্তোলন বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে যখন এগোন হচ্ছিল, তখন যুদ্ধ এল। আমেরিকা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে এর জেরে। ফলে বাজারে তেলের পরিমাণ কমে যাওয়ায়, তার দাম বাড়ছে। টাকার দাম পতনেরও শনির দশা শুরু হয়েছে, এখন অবশ্য সামান্য ভাল। কিন্তু এই সামান্য ভাল-টা করতে গিয়ে আইবিআইকে বেচতে হয়েছে অনেক ডলার। ডলারের তুলনায় টাকা ৭৬ থেকে ৭৭ টাকা যখন হচ্ছে, সেই সময় আরবিআই তার ঝুলি থেকে ওই ডলার বিক্রির অস্ত্রটি বার করে। মার্চের ৮ তারিখ আরবিআই ৫.১৩৫ বিলিয়ন ডলার দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে বিক্রি করে টাকা নেয়। এমনটা আগেও হয়েছে অনেক বার। এই ভাবে ডলারের জোগান বাড়ানো হয় বাজারে, যাতে ওই বিদেশি মুদ্রার চড়চড়িয়ে দাম বৃদ্ধিটাকে রোখা যায়। কিন্তু এতে তো কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভও কমে, তাই না!
আরও পড়ুন Explained: মুদ্রাস্ফীতি লাগাম-ছাড়া, দামে জর্জরিত জনগণ, কী ভাবে মুদ্রাস্ফীতির হার স্থির হয়?
টাকার উপর চাপ
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মার্চে যে পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নিয়েছেন, তার পরিমাণ ৪১ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। তার আগে, ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি অর্থ বেরিয়ে গিয়েছে ৪৫ হাজার ৭২০ কোটি টাকার। ক'দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার বৃদ্ধি করেছে দশমিক ২৫ শতাংশ, সেই সম্ভাবনা ঘনিয়ে ওঠার পর থেকেই বিনিয়োগকারীরা অর্থ তুলে নিচ্ছেন। কারণ, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আরবিআই সুদের হার বাড়ায়নি, ফলে ভারতের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এখন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দুইয়ের মধ্যে ফারাক-বৃদ্ধি স্বল্প মেয়াদি লাভের পক্ষে রীতিমতো আদর্শ। এবং এই বিদেশি বিনিয়োগ বেরিয়ে যাওয়াটা টাকার উপর চাপ তৈরি করেছে, কারণ ডলারের পরিমাণ কমে গিয়েছে, জোগান কমলে দাম তো বাড়বেই তার। টাকার পরিমাণ বাড়ছে, তার দাম উল্টো পথে কমবেই। ফরেন কারেন্সি, মানে বিদেশি মুদ্রার যে ভাণ্ডার, তা ১১ মার্চ শেষ হওয়া সপ্তাহে কমে গিয়েছে ১১.১০৮ বিলিয়ন। পৌঁছেছে ৫৫৪.৩৫৯ বিলিয়ন ডলারে।
আরবিআইয়ের উপর সুদের হার বাড়ানোর এখন চাপ রয়েছে। কিন্তু কতটা সুদ তারা বাড়াবে, কবে এই পদক্ষেপ, জল্পনা চলছে।