ভারতীয় তাপবিদ্যুতে কয়লা-সঙ্কট। থার্মাল স্টেশনগুলিতে রয়েছে গড়ে চার দিনের কয়লা। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী আর কে সিং অবশ্য জানাচ্ছেন, এই যে কয়লা সরবরাহের অভাব তৈরি হয়েছে। তার ফলে এখনও কোনও বিদ্যুৎ-বিচ্ছেদ বা পাওয়ার কাট হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে চিন্তার শত-রেখা ফুটে উঠেছে সরকারের কপালে এবং কোনও ভাবেই তা লুকানো যাচ্ছে না। আগামী ৬ মাস এই চিন্তাটা পুরো যাবে না বলেও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই কয়লা-ঘাটতির কারণটা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে।
কয়লা ঘাটতির ছবিটা কী?
বিভিন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে গড় কয়লা মজুতের পরিমাণ চার দিনে নেমেছে কিন্তু সরকারি নির্দেশিকা হল, ১৪ দিনের কয়লা মজুত থাকতে হবে। অক্টোবরের ৪ তারিখ পরিস্থিতি ভীষণ সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। কারণ, ১৬টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের (মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৭, ৪৭৫ মেগাওয়াট) কোল-স্টক নেমে আসে শূন্যে। ৫৯,৭৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন ৪৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা-মজুত পৌঁছে যায় দু'দিনে। দেশে কয়লা ঘাটতি দেখা দেওয়া মোট ১৬৫ গিগাওয়াট ক্ষমতা-সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির মধ্যে যে সব কেন্দ্রে শঙ্কার নজর দিয়ে রাখতে হচ্ছে প্রতিদিন, সেগুলির মোট ক্ষমতা ১৩২ গিগাওয়াট। পরিস্থিতি একেবারে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার শামিল হয়ে উঠেছে। যে কেন্দ্রগুলি কয়লাখনির নিকটবর্তী নয়, তাদের হালও আরও খারাপ। কয়লা খনির কাছাকাছি নয় ১০৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৯৮টি গভীর সঙ্কটে। এই সব কেন্দ্রে টায়েটুয়ে মাত্র আট দিনের কয়লা মজুত রয়েছে বলে খবর। এখানে বলে নিতে হবে, এ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৪ শতাংশ কয়লাজাত। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির উৎপাদন ক্ষমতা ৩৮৮ গিগাওয়াট, এর মধ্যে ২০৮.৮ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির।
কেন কয়লা সঙ্কট?
কোভিড কালে অর্থনীতিতে যে মন্দগতি দেখা গিয়েছে, একটা সময়ে যা চরমে উঠেছিল, সেটা কাটছে। নিজের ছন্দে ফিরছে অর্থনীতির চাকা। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে তাই, কিন্তু কয়লা মিলছে না, কারণ, চাহিদা কমায় কেন্দ্রগুলি কয়লার বরাত কমিয়ে দিয়েছিল। একটা হিসেব দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই বছরের অগস্টে আমাদের দেশে ১২৪ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়েছিল, আর ২০১৯-এ লেগেছিল ১০৬ বিলিয়ন ইউনিট। এর মধ্যে কয়লা থেকে উৎপন্ন হওয়া বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে বেশ অনেকটা। ২০১৯ সালে ৬১.৯ শতাংশ ছিল যা। এখন সেটা পৌঁছেছে ৬৬.৪ শতাংশে। জানা যাচ্ছে, ২০২০ সালের যে দৈনিক চাহিদা ছিল, তার থেকে ১৫ গিগাওয়াট বেড়েছে এই অক্টোবরের দৈনিক চাহিদা। অক্টোবরের ৪ তারিখে দেখা গিয়েছে ১৭৪ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ লেগেছে সারা দেশে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বিদ্যুৎমন্ত্রী বলেছেন, এই সময় ২৮. ২ মিলিয়ন বাড়ি বেড়েছে, যে সব বাড়িতে স্বাভাবিক ভাবেই আলো জ্বলছে, ফ্যান, টেলিভিশন ইত্যাদি চলছে, ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। 'আমরা ২০০ গিগাওয়াটের নীচে চলে গিয়েছি কোভিড-কালে, চাহিদা ঘোরাফেরা করছিল ১৭০-১৮০ গিগাওয়াটে, এখন মনে হচ্ছে আবার ২০০ গিগাওয়াটের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে চাহিদা।'
তবে এত বড় সঙ্কট কোনও একটি কারণে হয় না, আরও আছে। আর একটি কারণ হল বৃষ্টি। খনি অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে এবার, এতেই কয়লা উৎপাদন ধাক্কা খেয়েছে। খনি থেকে কম কয়লা পাঠানো সম্ভব হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার চড়া চামের ফলে আমদানিতেও কাটছাঁট করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন WHO-র নয়া দূষণ-নিয়মে ভারতের মহাসমস্যা, কেন?
সঙ্কট মেটাতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার?
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে পরিস্থিতি দেখরেকের জন্য। (যার মধ্যে রয়েছেন বিদ্যুৎ এবং রেল মন্ত্রকের প্রতিনিধিরা। কোল ইন্ডিয়া, সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি, পাওয়ার অপারেশন কো-অপারেশনের প্রধিনিধিরা।) কোল ব্লকগুলি থেকে আরও বেশি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে যাতে পৌঁছয়, বিদ্যুতের উৎপাদন আরও বাড়ানো যায় যাতে, সেই চেষ্টায় কোমর বেঁধেছে বিদ্যুৎমন্ত্রক। সে ক্ষেত্রে ছাড়পত্র পেলেও যে সব খনিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়নি, সেগুলিকে উত্তোলনপর্বে দ্রুত যেতে চাইছে মন্ত্রক।
বিদ্যুৎমন্ত্রী বলেন, 'কোনও কোনও খনি ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে, কিন্তু নিলাম চলছে। আবার কোথাও ছাড়পত্র মেলেনি এখনও।' এ সব বাধাই কী করে দ্রুত পেরোন যায়, সেই প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। খনি থেকে বিদ্যুৎপ্রকল্পে এসে পৌঁছানো কয়লার পরিমাণ বাড়ানোর দিকেও নজর দিয়েছে সরকার। রবিবার ২৪৮ রেক কয়লা খনি থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গিয়েছে, সোমবার তা-ই বেড়ে হয় ২৬৩ রেক। সরকার জানিয়েছে, এই পরিমাণটা আরও বাড়বে।
মরাল অফ দ্য স্টোরিটা তা হলে কী? বিদ্যুৎ-ঝড়ের পূর্বাভাস এসেছে। বিপর্যয় ঠেকাতে হবেই। সব রকমের চেষ্টা না চালানো ছাড়া উপায় কি?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন