/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/09/Jalianwala-Bagh-Revamp.jpg)
উঠেছে ইতিহাস মুছে দেওয়ার কড়া জাতীয় অভিযোগ।
জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢোকার গলিপথের অমূল সংস্কার। যে ভাবে ভোল বদলেছে, তাতে পরিকল্পনাকারীরা কাঠগড়ায়। উঠেছে ইতিহাস মুছে দেওয়ার কড়া জাতীয় অভিযোগ। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। সেই রোমহর্ষক, হাহাকার ও কান্নার দিন। কর্নেল ডায়ারের নির্দেশে সে দিন ব্রিটিশ বাহিনীর গুলির ঢেউ ওঠে। নিহত হাজারের বেশি। ইতিহাসের সেই রূঢ় ও আসল চিহ্নগুলি মুছে দেওয়া, মানতে পারছেন না অনেকেই। তাঁরা এর পিছনে থাকা মস্তিষ্কের ভিতরে ঝাঁপ কেটে নেমে দেখতে চাইছেন এই উর্বরতার নেপথ্যে আছেটা কী?
জালিয়ানওয়ালাবাগের ইতিহাসটা ঝালিয়ে নেওয়া যাক
রাউলাট আইন। ইংরেজ আমলের ড্র্যাকোনিয়ান অ্যাক্ট। বিচারপতি সিডনি রাউলাটের মাথা থেকে রেরিয়ে আসা এই আইনটিতে পুলিশকে উজাড় করে দেওয়া ক্ষমতা। এই অস্ত্রে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার, বিচার ছাড়াই আটক, যত দিন খুশি। অভিযুক্তরা এমনকি জানতেও পারতেন না অভিযোগ কার বা কাদের। পঞ্জাবে এই আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ডানা মেলতে শুরু করেছিল ভালই। কখনও ছোট, কখনও বড় অশান্তি পথেবিপথে, চলছিলই। মহাত্মা গান্ধি ট্রেনে পঞ্জাবের উদ্দেশে রওনা দিলেন প্রতিবাদে অংশ নিতে, এবং তা সংহত করে তুলতে। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ হল না, মহাত্মাকে পথমাঝে গ্রেফতার করা হল। এর ফলে আরও ক্ষোভ। পঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট জেনারেল তখন মাইকেল ও' ডায়ার। জারি সেনাশাসনও। ব্রিটিশ যেন ক্ষেপে উঠেছে। পুরো অরাজকতার ঘুড়ি-- উড়ছে। বিদ্রোহীদের উপর দমনপীড়ন, গ্রেফতারি। রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গ্রেফতার সত্যপাল ও সইফুদ্দিন কিচলু।
তারই বিরুদ্ধে ১৩ এপ্রিল বৈশাখীর দিন, মানে নববর্ষে, জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রতিবাদ সভা। দিনটা রবিবার। ফলে অনেকেই হাজির হলেন বাগে, প্রতিবাদের ফুল তুলতে। যুবা, বাচ্চা, বুড়ো। সভাসমিতিতে নিষেধাজ্ঞা-- মানব না মানছি না-- বুড়ো আঙুল। তাঁদের দাবি, রাউলাট আইন বাতিল করো। মুক্ত করো সত্যপাল, সইফুদ্দিনকে। জালিয়ানওয়ালাবাগে চার দিকে পাঁচিল। তার উচ্চতা ১০ ফুট। বেরনোর পথ সরু। জেনারেল ডায়ার সেনা নিয়ে গটমটিয়ে হাজির। তার চোখ চকচক, হত্যার নেশা যেন জেগে উঠছে। ৯০ জন বালুচ ও গোর্খা সৈন্য-- ইংরেজ জওয়ান মাত্র চার। বিক্ষোভ পুরোপুরি শান্তির পথে। কিন্তু ইংরেজ তো আতঙ্কে। মিউটিনির ভয়ানক ভয়। এই আন্দোলনটা যদি তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নেয়, তা হলে! ফলে-- ফায়ার… রেজিনাল্ড ডায়ারের চিৎকার। প্রায় ১০ মিনিট ধরে গুলিবর্ষণ। সংকীর্ণ বেরনোর পথ আটকে। একটা ম্যাগি তৈরির সময়ের মধ্যে হাজারের বেশি মানুষ খতম। বহু জন জখমও। যাঁরা বাঁচলেন, মনে মনে অবশ্য তারা শেষ। জানা যায়, যতক্ষণ না গুলি তলানিতে ততক্ষণ গুলিবর্ষণ জারি ছিল। পুরো গুলিশূন্য হয়নি, কারণ ফিরে যাওয়ার পথে যদি কিছু হয়, বলা তো যায় না!
ব্রিটিশের হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৩৭৬। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের হিসেব। যিনি ঘটনা নিন্দা করেই দায় সারলেন। অবশ্য তা না করা ছাড়া তাঁর কোনও উপায়ও ছিল না। প্রতিবাদকারীরা সশস্ত্র, এমন বলে মিথ্যের মিনারে উঠলেন। যা হোক, নিহতের তালিকায় বছর ৯-এর শিশু সর্বকনিষ্ঠ, এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধ বয়স্কতম। বেঁচে যাঁরা গেলেন, তাঁর মধ্যে ২১ বছরের একটি ছেলে ছিলেন, নাম-- উধম সিং। সে দিনই শপথ নিলেন প্রতিশোধ নেবেন। নিলেনও। সেদিন গদর পার্টির উধম লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ও' ডায়ার। ১৯৪০-এর ১৩ মার্চ। যখন ডায়ার বক্তৃতা দিতে ডায়াসের দিকে যাচ্ছেন, তখনই-- ৭৫ বছরের ওই বৃদ্ধকে ফুঁড়ে গেল চল্লিশ পেরনো উধমের গুলি। উধম একটি বইয়ে লুকিয়ে এনেছিলেন রিভলভার। বইয়ের পাতা কেটে রিভলভার লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ডায়ারের হার্ট এবং ফুসফুস ফুঁড়ে গেল দুটি গুলিতে। স্টেজেই ও'ডায়ার স্পন্দনহীন। আর কর্নেল রেজিনাল্ট ডায়ারের কী হল? হত্যাকাণ্ডের পক্ষে হাজারো যুক্তি দিলেন বাকি জীবন। লিখলেনও। তাঁর মৃত্যু ২৩ জুলাই, ১৯২৭-এ। ব্রেন হেমারেজে।
হত্যাকাণ্ডের পর জালিয়ানওয়ালাবাগে কী হল?
ষষ্ঠীচরণ মুখোপাধ্যায়, এক বাঙালি, হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, সেই দিন হাজির ছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে। সেই বছর, মানে ১৯১৯-এর শেষে কংগ্রেসের অধিবেশনে, অমৃতসরে, বাগ অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব আনেন তিনি। ইংরেজরা চাইছিল এই জায়গায় জামাকাপড়ের বাজার হোক, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সব চিহ্ন মুছে দেওয়াই লক্ষ্য। কিন্তু ভারতীয়দের লাগাতার বাধায় তা হতে পারেনি। মহাত্মা গান্ধি এই বাগটি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল তৈরির ডাক দেন এর পর। সারা দেশে তাতে ভালই সাড়া পড়ে। মদন মোহন মালব্যকে সভাপতি এবং ষষ্ঠী মুখোপাধ্যায়কে সম্পাদক করে ট্রাস্টও গঠন করা হল। ৫ লক্ষ ৬০ হাজার ৪৭২ টাকা ওঠে তাতে, এক বছরে। জালিয়ানওয়ালাবাগের মালিক হিম্মত সিংয়ের কাছ থেকে সেই অর্থে ৬.৫ একর এলাকাটি কিনে নেওয়া হয়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/09/Lotus-Pond.jpg)
স্বাধীনতার পর জালিয়ানওয়ালাবাগের কী হল?
১৯৫১ সালের ১ মে জালিয়ানওয়ালাবাগ ন্যাশনাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করল কেন্দ্রীয় সরকার। আমেরিকার ভাস্কর বেঞ্জামিন পোলকের উপর 'স্বাধীনতার বহ্নিশিখা' তৈরির ভার পড়ল। স্মৃতি-ভাস্কর্যটি নির্মাণের খরচ পড়েছিল ৯ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা। জালিয়ানওয়ালাবাগে এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তথা জালিয়ানওয়ালাবাগ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জওহরলাল নেহরু। ১৯৬১ সালের ১৩ এপ্রিল বাগে 'স্বাধীনতার বহ্নিশিখা' জ্বলে উঠল। সে দিনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন দেশের প্রথম সারির আরও অনেকে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/09/Wall.jpg)
নতুন বিতর্কের কারণ কী?
জালিয়ানওয়ালাবাগ মেমোরিয়াল নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সারানো হয়েছে মাঝে মধ্যেই। কিন্তু বাগে ঢোকার সরু রাস্তাটায় হাত পড়েনি একশো বছরের মতো। মুঘল যুগের নানকশাহি ইট দিয়ে তৈরি ছিল এই রাস্তাটার দু'দিকের দেওয়াল, ইতিহাস জাগিয়ে তা ছিল অবিকৃত। গত জুলাইয়ে ম্যুরাল দিয়ে দেওয়াল অলঙ্কৃত করা হয়েছে। ফলে অতীতের চিহ্নগুলো উধাও। এতেই প্রশ্ন-- ঘোরতর ও গুরুতর। এমন মেক-ওভারের কোনও দরকার ছিল কি?
অনেকেই বলছেন-- ছিল বিড়াল, হয়ে গেছে রুমাল। ছিল-- সরু গলি, অন্ধকার বেশি, আলো কম যেখানে, যা পেরিয়ে ডায়ারের নেতৃত্বে সেনারা ঢুকে ছিল, তার পর গলির মুখ আটকে রেখে গুলির বন্যা। এখন গলি থেকে সেই ইতিহাস হারিয়েছে-- তা ঝাঁ-চকচকে। নয়নাভিরাম দেওয়াল। পুরানো সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথাটা দেওয়ালের গা থেকে এই ভাবে মুছে দেওয়া কি আরেক হত্যা নয়? ইতিহাসের গর্ভে কে জানে এই প্রশ্ন আদৌ টিকে থাকবে কি না?