নাগাল্যান্ডের ওটিংয়ে সেনার বিরুদ্ধে গণহত্যার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সেনার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরও করেছে নাগাল্যান্ড পুলিশ। আফস্পা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট আবারও নড়চড়ে উঠেছে। আইনটি প্রত্যাহারের দাবিতে নাগাল্যান্ড সরকার চিঠিও লিখতে চলেছে কেন্দ্রকে। শনিবারের ঘটনাটা কী? নাগাল্যান্ডের মন জেলায় খনি শ্রমিকরা ঘরে ফিরছিলেন, ওটিং এলাকায় তাদের জঙ্গি মনে করে গাদা গাদা গুলি সেনার। ভুল হয়ে গিয়েছে বিলকুল, বোঝা গেল তার পরই। এবং দারুণ বিতর্ক। ঝড়ও। সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানালেন, শ্রমিকদের গাড়ি থামাতে বলেছিল সেনা, কিন্তু তাঁরা না মানায় গুলি চলানো হয়।
সেনার ২১ নম্বর প্যারা স্পেশাল ফোর্সের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ, তাদের না জানিয়েই বাহিনী অভিযানে গিয়েছিল, এবং বিনা প্ররোচনায় গুলি বর্ষণ করেছে। ওটিংয়ের ঘটনার দ্বিতীয় পর্ব আরও মর্মান্তিক, সংসদে অমিত শাহের বক্তব্য অনুযায়ী, জওয়ানদের গুলিতে ৬ জনের মৃত্যুর পর, গ্রামবাসীরা বাহিনীর উপর হামলা চালায়। সেনার দুটো গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, এতে এক জওয়ান নিহত আরও আরও কয়েক জন আহত। আত্মরক্ষার্থে বাহিনী গুলি চালালে আরও সাত গ্রামবাসী নিহত, পরে আরও এক আহত গ্রামবাসী মারা যান, গ্রামবাসীদের মৃত্যু-সংখ্যা এর ফলে-- ১৪। এই ঘটনায় আফস্পা কেন নিশানায়, এই আইনটি কী, এতে কোথায় সেনার জোর-- সেই দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
আফস্পা কী?
আফস্পা। শুরুতেই বলেছি পুরো নাম-- আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট। যার বাংলা, সেনা বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন। অশান্ত অঞ্চল বা ডিস্টার্বড এরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এই আইনে। এই আইন বলে সেনা বাহিনী পরোয়ানা ছাড়া যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, পরোয়ানা ছাড়া কারওর বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালাতে পারে। গুলি চালানোর অধিকারও দেওয়া হয়েছে সেনাকে এই আইনেই, শাসনের দণ্ডে যাতে কোনও আঁচ না আসে, সব ব্যবস্থা এতে রয়েছে।
কোথায় কেন আফস্পা?
কোনও অঞ্চলকে অশান্ত হিসেবে ঘোষণা করা হলে, সেখানে আফস্পা প্রয়োগ করা যায়। কোন অঞ্চল ডিস্টার্বড, তা স্থির করার দায়িত্ব আইনে প্রথমে রাজ্যের হাতে ছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালে কেন্দ্র তা নিজের হাতে আনে। আফস্পার তিন নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল বা কেন্দ্রীয় সরকার যদি মনে করে, তা হলে কোনও এলাকাকে ডিস্টার্বড বলে ঘোষণা করা হতে পারে। বর্তমানে আফস্পা জম্মু-কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, অসম, মণিপুর (ইম্ফলের সাতটি বিধানসভা বাদে) এবং অরুণাচল প্রদেশের কিছু আংশে রয়েছে। আফস্পা প্রত্যাহারও করা হয়েছে বেশ কিছু এলাকা থেকে। যেমন ২০১৫ সালে ত্রিপুরা এবং তার পর ২০১৮ -তে মেঘালয়কে আইনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। অরুণাচল প্রদেশেও এর প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে।
কবে আলো দেখল এই আইন?
১৯৪২ সালের আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অর্ডিন্যান্সের উপর ভিত্তি করে এই আইন তৈরি। ৪২-এ অর্ডিন্যান্সটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আনা হয়েছিল। আফস্পা ১৯৫৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাশ হয় সংসদে। উত্তরপূর্বে এর প্রথম প্রয়োগ হয়। তার পর পঞ্জাবে। অসমে নাগা বিদ্রোহ বা নাগা বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়তেই মূলত এই বিল। লোকসভায় পেশ করা হয় ১৯৫৮ সালের ১৮ অগস্ট। দু' ঘণ্টা ধরে চলেছিল বিতর্ক। আলোচনা এর পর হয় যথানিয়মে রাজ্যসভায়। অগস্টের ২৫, ২৭ এবং ২৮ তারিখ। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ আইন প্রসঙ্গে বলেন, ভুল পথে পরিচালিত নাগাদের নিয়ন্ত্রণে এটি খুব সাধারণ একটি পদক্ষেপ। তাঁর যুক্তি, বড় এলাকার কোথাও কোনও অশান্তি হলে দ্রুত সেনাকে পৌঁছতে হয়, ব্যবস্থা নেওয়ার আগে জেলাশাসকদের অনুমতি নেওয়া সম্ভব হয় না। সেনা বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়ার তাই দরকার। প্রবল প্রতিবাদের মধ্যে কোনও সংশোধনী ছাড়াই লোকসভায় পাশ হয়ে যায় বিলটি।
রাজ্যসভায় বিলটি নিয়ে বিতর্ক চলার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেন, কোনও সরকার যেখানে খুশি তার কাজ করতে পারে। যদি কোথাও হিংসাত্মক কিছু ঘটে, সরকার তার মোকাবিলা করবেই। সে যে-কারণেই সেই হিংসা হোক না কেন। না হলে আপনারা পিছিয়ে পড়বেন, দেশও পিছিয়ে পড়বে। এটিকে যদি আমি ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি বলি, তা হলে যারা সন্ত্রাসে মদত দিচ্ছে, সন্ত্রাস করে সরকারকে অস্বীকার করছে, তাদের প্রশ্রয় দেওয়া হবে।
কেন বিতর্কিত?
ড্র্যাকোনিয়ন অ্যাক্ট। দানবিক আইন। আফস্পার সমালোচনা করা হয় এই ভাষায়। সেনা বাহিনীকে এই আইন বেলাগাম ক্ষমতা দিয়েছে, এবং যে কোনও কিছু করে, পার পাওয়ার সুযোগ দিয়ে দিচ্ছে। বক্তব্য সমালোচকদের। সন্দেহ বশেই সেনা গুলি চালিয়ে মেরে ফেলতে পারছে কাউকে, কোনও বাড়ি ধ্বংস করে দিতে পারছে এই আইন বলে। একজন নন-কমিশনড অফিসার কিংবা সমপদমর্যাদার কিংবা তার উপরের যে কোনও পদে থাকা আধিকারিক আফস্পার অস্ত্রে যে কাউকে গ্রেফতার বা গুলি চালানোর অধিকার পেয়ে যান। এর জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। আইন প্রয়োগে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন থাকাটাই একমাত্র শর্ত। ২০০৪ সালে জীবন রেড্ডি কমিটি তৈরি হয় আফস্পা-য়, আইনটি সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের সুপারিশ করে তারা। কমিটি বলেছিল, আফস্পা ঘৃণা ও শোষণের প্রতীক।
কী আন্দোলন?
আফস্পার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাসটা দীর্ঘ। মণিপুরের আয়রন লেডি ইরম শর্মিলা এটি প্রত্যাহারের দাবিতে ১৬ বছর ধরে অনশন করেছেন। ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে, অভিযোগ, ইম্ফলের তুলিহাল বিমানবন্দরের কাছে মোলোম তুলিহাল মাখা লেইকাই-এ অসম রাইফেলসের অষ্টম ব্যাটেলিয়ন গুলি করে মারে ১০ জনকে। এই ঘটনা মালোম ম্যাসাকার নামে পরিচিত। ঘটনার অভিঘাতে শর্মিলা অনশন শুরু করেন। আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে মাইস্টোন আন্দোলন হিসেবে যা পর্যবসিত। এখানে বলতে হবে, অনশন শুরুর তিন দিন পর, শর্মিলাকে গ্রেফতার করা হয়, অভিযোগ, তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। শর্মিলার এই অনশন শেষ হয়, ২০১৬ সালের ৯ অগস্ট।
২০০৪ সাল। তত দিনে অবশ্য শর্মিলার আন্দোলন গগনচুম্বী। নানা জায়গায় আফস্পার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে। এরই মধ্যে ২০০৪ সালের ১১ জুলাই বছর বত্রিশের থংজাম মনোরমার বুলেট বিদ্ধ ক্ষতবিক্ষত দেহ মিলল মণিপুরের পূর্ব ইম্ফলের কামপু গ্রামে। মনোরমার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে, পরিত্যক্ত এলাকায়। অভিযোগ, মনোরমাকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে অসম রাইফেলসের জওয়ানরা। মনোরমার ঘটনার প্রতিবাদে ২০০৪-এর ১৫ জুলাই ইম্ফল শহরে ৩০ জন মণিপুরী মহিলার নগ্ন মিছিল আমাদের বাকস্তব্ধ করল তার পর। একটি ব্যানার নিয়ে সেই মিছিল হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল-- 'ইন্ডিয়ান আর্মি রেপড আস'। জুলাইয়ের ২৪ তারিখ, মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের সামনে পাঁচ যুবক গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করলেন।
সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছিল আফস্পা নিয়ে?
২০১৬ সালে, আফস্পার গঠন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে সুপ্রিম কোর্ট। যে ভাবে এই বিহিনীকে ফ্রি-হ্যান্ড দিয়েছে আইন, তা ত্রুটিযুক্ত, বলে আদালত। একস্ট্রা জুডিশিয়াল এগজিকিউশন ফ্যামিলিস অ্যাসোসিয়েশন (EEVFAM)-এর আবেদনের ভিত্তিতে এই রায় দেয় শীর্ষ আদালত। মণিপুরে যাঁরা সেনার হাতে মারা গিয়েছেন বলে অভিযোগ, এটি তাঁদেরই পরিজনদের সংগঠন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এই আইন কোনও এলাকায় যদি দীর্ঘ সময় ধরে থাকে, সেটা প্রশাসন এবং সেনা-- দুইয়েরই ব্যর্থতা। শীর্ষ আদালত এও বলে, ফেক এনকাউন্টারের যে ১ হাজার ৫০০টি ঘটনার অভিযোগ উঠেছে গত বিশ বছরে, তার তদন্ত হওয়া অত্যন্ত দরকার। EEVFAM-এর অভিযোগ, ১৯৭০ সাল থেকে মোট ১ হাজার ৫২৮টি ফেক এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে মণিপুরে। এর জন্য দায়ী আফস্পা, ফলে আফস্পা প্রত্যাহার না করলে চলবে না।
এত অভিযোগ, এত আন্দোলন, অনশনের দীর্ঘ আখ্যান-- মাথায় নিয়েও আফস্পা রয়েছে। সরকার যাচ্ছে, সরকার আসছে, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিও বদলাচ্ছে। মাঝে মাঝে রক্তমাখা খবরগুলো কাঁটার মতো বিঁধেও থাকছে। কিন্তু… আফস্পাকে বাতিল কাগজের ঝুড়ি টেনে নিচ্ছে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন