এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ারের সঙ্গে দশ দিনে তিন বার মোলাকাত হয়েছে ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের। এ রাজ্যে তৃণমূলের জয়ের ধ্বজা ওড়ানোর নেপথ্য কারিগর কিশোর। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে শরদকে ঘিরে সঙ্গে যখন তৃতীয় ফ্রন্টের জল্পনা আকাশ-বাতাসে, তখন প্রশান্ত কি হতে চলেছেন শরদের পাওয়ার? দু'জনের এই সিরিজ সাক্ষাৎ এই প্রশ্নটা তুলে দিয়েছে।
প্রশ্নের জন্ম কী ভাবে?
বিজেপির বিরুদ্ধে এক-জোট হয়ে লড়াই। অনেকের মত, তারই সলতে পাকানোর নয়া সংস্করণ দেখা গিয়েছে মঙ্গলবার। দিল্লিতে শরদ পাওয়ারের বাড়িতে। দল বেঁধে বিরোধীদের বৈঠকে। অবশ্য বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই আগেও করেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দাঁত ফোটাতে গিয়ে দাঁত ভেঙে গিয়েছে। ঢক্কানিনাদ সার হয়েছে শেষমেশ। এবার কোথায় টুইস্ট? টুইস্ট শরদ পাওয়ারে। ভারতীয় রাজনীতিকে যিনি নখদর্পণে রাখেন। তাঁর অঙ্গুলিহেলনে কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যাবে, কেউ জানে না।
শরদের বাড়ির এই বৈঠকে কিন্তু কংগ্রেসের কাউকে দেখা যায়নি। দু-দশক ধরে এনসিপি-র বন্ধু কংগ্রেস, তাদের গরহাজিরা শুরুতে ছন্দপতন কি, পক্ককেশ রাজনীতিকদের অনেকে সেই আলোচনায় আসর জমিয়েছেন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে এনসিপি নেতা মজিদ মেমন জানিয়ে দিয়েছেন, 'এই বৈঠকের আহ্বায়ক নন শরদ, বৈঠক ডেকেছিলেন যশবন্ত সিনহা।' যশবন্ত, যিনি গড়ে তুলেছিলেন রাষ্ট্র মঞ্চ, সেই মঞ্চেরই বৈঠক।
রাষ্ট্র মঞ্চের গোড়ার কথা
রাষ্ট্র মঞ্চ আসলে কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি ও প্রাক্তন কূটনীতিক কে সি সিংয়ের মস্তিষ্ক প্রসূত। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং প্রাক্তন বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহা (যিনি বিজেপি ত্যাগ করেন ২০১৮ সালে, এ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে), প্রাক্তন জেডিইউ নেতা পবন বর্মা এবং তৎকালীন তৃণমূল নেতা দীনেশ ত্রিবেদী (যিনি তৃণমূলে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এই ভোটের আগে) এবং আরও কয়েকজন এই মঞ্চের চক্ষুদান করেন। যশবন্তই প্রধান। ২০১৭-র শেষ দিকে এই মঞ্চ দানা বেঁধে ওঠে। রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে এই মঞ্চের প্রসার চেয়েছিলেন যশবন্তরা। চেয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের যে অংশের সুর মিলে যায়, তাঁদের মঞ্চে আনতে। লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক-- যাঁরা কোনও দলের দুনিয়ায় পড়েন না, তাঁরাই লক্ষ্যে।
২০১৮-র জানুয়ারির ৩০ তারিখ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই মঞ্চের ঘোষণা করেন যশবন্ত। সেই দিন দীনেশ ত্রিবেদী, পবন বর্মারা তো ছিলেনই, হাজির হয়েছিলেন এনসিপি সাংসদ মজিদ মেমন, আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিং, গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরেশ মেহতা, আরজেডি নেতা জয়ন্ত চৌধুরী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সোম পাল, হরমোহন ধাওয়ান, এবং বিহারীবাবু শত্রুঘ্ন সিনহা। যশবন্ত বলেন, 'হতে পারে এটা রাজনৈতিক মঞ্চ, কিন্তু কোনও দিন রাজনৈতিক দল হবে না। মানুষের আন্দোলন হবে এই মঞ্চে। কোনও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে (প্রথাগত ভাবে) যাবে না। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুগুলিকে তুলে ধরে মাঠে নামবে।
তার পর থেকে রাষ্ট্র মঞ্চ কী করল?
দেশে যে ভেদাভেদের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে স্বর এই মঞ্চ। এর সদস্যরা দিল্লিতে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কমল মোরারকা-র বাড়িতে বৈঠক করে থাকেন। প্রোফেসর অরুণ কুমারের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও দেখা গিয়েছে বৈঠকে। ২০২০-র জানুয়ারিতে যশবন্তের ডাকে এই মঞ্চের ব্যানারে গান্ধি শান্তি যাত্রা হয়েছে। এই যাত্রা ছিল সিএএ, এনআরসি-র বিরুদ্ধে। সময়ের গতিতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে যশবন্ত যোগ দিলেন তৃণমূলে, বিজেপি পরাজিত হল এ রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাক ফেডেরাল ফ্রন্টের। ২৪-এর ভোট-নজরে, সে ডাক এখন উজ্জীবিত। যশবন্তের রাষ্ট্র মঞ্চ কি মমতার ফেডেরাল ফ্রন্টের নব-চারণভূমি হয়ে উঠছে? নতুন এক শক্তির সূচনা কি হয়ে গিয়েছে?
ফেডেরাল ফ্রন্ট-- এই ভাবনার চাকা টিআরএস প্রধান তথা তেলেঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের হাতে গড়িয়েছিল প্রথমে। কে চন্দ্রশেখর রাও, যিনি কেসিআর হিসেবে প্রসিদ্ধ, দেখা করেছিলেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে। সেটা ২০১৮ সাল। কিন্তু বেশি দূর এগোয়নি চাকা। ২০১৯-এর নির্বাচন দুই দল আলাদা আলাদা ভাবে লড়েছিল। ১৯-এ বিজেপির বিপুল জয় বিরোধীদের সব সমীকরণ তছনছ করে দিল। তৃতীয় ফ্রন্টের কথা বলা কেসিআর চুপ করে গেলেন, তা-ই নয়, সংসদে নানা সময় তাঁকে দেখা গেল বিজেপিকে সমর্থন করতে। তৃতীয় ফ্রন্টের ধ্বজাধানী বামেরাও চলে গেল ব্যাকফুটে।
মঙ্গলবারের বৈঠকের গুরুত্ব কী?
শরদ পাওয়ার মঞ্চে প্রবিষ্ট হয়েছেন। এটাই অনেকের ভিতরে শিহরণ জাগিয়েছে। রাজনৈতিতে শরদের ক্যারিশমা কম নেই। বেশি দিনের কথা নয়, মহারাষ্ট্রে ভোটের ফলাফল বেরনোর পর দেখা যায়, কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। শিবসেনার সঙ্গে তখতের লড়াই শুরু হল বিজেপির। তা-ই কাজে লাগিয়ে শরদের মস্তিষ্ক মারাঠা রাজ্যের পাশা পাল্টাল। সরকার গড়ল শিবসেনা, কংগ্রেস, এনসিপি। শিবসেনার সঙ্গে এই জোট তো অনেকের কল্পনার অতীত ছিল। সত্যি ভাবা যায় না! কিন্তু শরদের বাড়িতে মঙ্গল-বৈঠকে কংগ্রেসের কেউ ছিলেন না কেন? কংগ্রেসকে রাষ্ট্র মঞ্চের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত কি নেওয়া হয়েছে তবে?
মেমন জানান, তেমন কোনও ব্যাপার মোটেই নয়। কংগ্রেসের পাঁচ জন নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাঁরা আসেননি। দাবি, ব্যক্তিগত ভাবে ফোনে সেই সব নেতা মেমনকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা রাষ্ট্র মঞ্চের সঙ্গে আছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মত, এখন জল মাপার কাজটা করছে রাষ্ট্র মঞ্চ। কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলকেই তারা বার্তা দিতে চাইছে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বার্তাটা খুব স্পষ্ট। কেউ কেউ বলছেন, ঘর পুড়ছে তবুও পিঠ ফিরে শুচ্ছে কংগ্রেস, এবার জাগুন, জাগুন… হয়তো সেই কথাই বলছে রাষ্ট্র মঞ্চ।
কয়েক জন বিরোধী নেতা এও মনে করছেন, কংগ্রেসের জন্য অপেক্ষা করে বসে না থেকে হাতে হাত মিলিয়ে মাঠে নেমে পড়া উচিত এখনই। যদি চায় পরে এসে কংগ্রেস যোগ দিতেই পারে জোটে। তাতে তো বাধা নেই! বাম দলগুলির মত অবশ্য একটু আলাদা। তারা বলছে, কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল, সারা দেশে তার উপস্থিতি, অ-বিজেপি কোনও জোট কংগ্রেসকে ছাড়া খাড়া করে তোলা সম্ভব নয়।
যা হোক, আবার বলতে হচ্ছে, পওয়ারের এন্ট্রিই আলোচনার লয় চৌ-গুণে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি শরদ নতুন কোনও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন? পওয়ারের সঙ্গে বেশির ভাগ নেতারই সম্পর্ক ভাল। রাজনীতিতে তাঁর অগাধ গভীরতা। এখনও জলে মাছের মতো তিনি রাজনীতির জলে চলাফেরা করেন। নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য পওয়ারকে অনেকে উপযুক্ত বলে মনে করেন। তবে, মারাঠা স্ট্রংম্যানের বয়স হয়েছে। আগামী লোকসভা ভোটে তিনি ৮৩-তে পৌঁছে যাবেন। বয়সের এই বিপুল ভার কি তাঁকে পিছনের পায়ে ঠেলে দেবে না?
বিরোধীদের একাংশের মত, বয়স হয়েছে তো কি, মহারাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলই বুঝিয়েছে শরদ বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখানোর ক্ষমতা রাখেন এখনও। বলাবলি চলছে যে, লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী দলগুলি যদি জোট করে, তা হলে আসন ভাগ নিয়ে ম্যারাথন কথাবার্তার প্রয়োজন পড়বে। একজন সর্বজনগ্রাহ্য নেতাকে সামনে না রাখলে সে কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হবে না কিছুতেই। এখানে শরদের গুরুত্ব।
এবার আসা যাক প্রশান্ত কিশোরে
শরদ পওয়ারের পর যিনি সবচেয়ে চর্চিত, তাঁর নাম প্রশান্ত কিশোর। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মমতার বিরাট জয়ের প্রশান্ত-ভূমিকা এখন ইতিহাস। ফলে প্রশান্তের ঘুড়ি সাঁই সাঁই করে উড্ডীন। দশ দিনে তিন বার শরদের সঙ্গে তিনি দেখা করে ফেলেছেন। ১১ জুন প্রথম দেখা, তার পর সোমবার আবারও। সেই সাক্ষাতের পর শরদের বাড়ি বিরোধী দলগুলির বৈঠক হল। বিকেল চারটে থেকে আড়াই ঘণ্টা। বুধবার আবারও প্রশান্ত হাজির শরদের বাড়ি। সকাল সাড়ে নটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত কথা। এত 'কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে…'
কিশোরের রাজনৈতিক যোগাযোগ দুরন্ত। মমতা তো আছেনই, কে না জানে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তিনি। ডিএমকে ও ওয়াইএসআরের হয়ে ভোট কৌশলীর কাজ করেছেন। তাই এম কে স্ট্যালিন ও ওয়াই এস জগন্মোহন রেড্ডির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক তিনি ঝালিয়ে নিতেই পারেন। এখন পাওয়ারের সঙ্গে যদি প্রশান্তের জুটি তৈরি হয়, ভোটের তরণী যে হু হু করে এগিয়ে যাবে, তাতে নিঃসন্দেহ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। প্রশান্ত অবশ্য বলছেন, 'আমি বিশ্বাস করি না এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনও তৃতীয় বা চতুর্থ ফ্রন্ট বিজেপি-কে সফল ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড় দিতে পারে। এ রকম কোনও কিছুর সঙ্গে যুক্ত নই আমি।' কিন্তু দুই-দুই যে চার হয়, তা প্রশান্ত স্বীকার না করলেও, সকলেই সহজ ভাবে জানে!
তৃতীয় ফ্রন্ট হলে কংগ্রেসের কি কোনও লাভ হবে?
কংগ্রেসের এ থেকে তেমন পাওয়ার কিছু নেই। বরং হারানোর কিছু থাকতে পারে। যদি তৃতীয় ফ্রন্টে কংগ্রেস থাকে, যদি নেতৃত্ব দেওয়ার মতো জায়গায় না থাকে, তা হলে শতাব্দী প্রাচীন এই দলের ক্ষেত্রে সেটা ভাল দেখাবে না। কংগ্রের সঙ্গে অনেক দলের টানাপোড়েন। যেমন আপ, টিআরএস, অকালি দল, বিজেডি নিজেদের ঘাঁটি-রাজ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াকু। সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টির মতো দল কংগ্রেস থেকে দূরত্ব রাখতে চাইবে। নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কংগ্রেসকে নেতৃত্বে রেখে বিরোধীদের ঐক্য তৈরি না হলে, সাফল্য আসবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, এমনকী নবীন পট্টনায়ক এবং উদ্ধব ঠাকরেরা যদি হাত মেলান, যদি শরদ পাওয়ার নেতৃত্ব কিংবা চাণক্যের ভূমিকায় থাকেন, যদি প্রশান্ত কিশোর কৌশলের ক্ষেপণাস্ত্র রচনা করেন, তা হলে কংগ্রেসের পক্ষে সেটা সুখকর হবে না। বিজেপি বিরোধী হাওয়ার পুরোটাই এরা কেড়ে নিলে কী করবে কংগ্রেস! ইগো ছেড়ে তৃতীয় ফ্রন্টে গেলে অস্তিত্বের ভয়, না গেলে পরাজয়ের আশঙ্কা। অভয়বার্তা কোথা থেকে পাবে রাহুলের দল? না কি ভোটে একাই কামাল করে অন্য কোনও সমীকরণ সৃষ্টি করবে তারা?
শরদ পাওয়ারের এই মুভ এই ভাবে অনেক কিছুর জন্ম দিচ্ছে। তৈরি করছে বিজেপি বিরোধী নবতরঙ্গ। ২৪-এর ভোটে এই তরঙ্গ শেষ পর্যন্ত সুনামি হবে কি, প্রশ্নের উত্তর সময়ের গর্ভে।