কড়াটা নাড়ছিল, জুনে ঘরে ঢুকে পড়েছে তেল-সঙ্কট। না, ভোজ্য তেলের কথা বলছি না, বলছি জ্বালানি তেলের কথা। এ মাসে দেশের নানা শহরের পাম্পে রেশন করে তেল সরবরাহ করা হয়েছে, আবার অনেক পেট্রোল পাম্প তেলের অভাবে দরজা বন্ধ করেও রেখেছিল। এই ঘটনায় এক আতঙ্কের হিমেল শিহরণ মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে এসেছে, তা হলে কি জ্বালানি তেলের মহাসঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। মধ্য জুনে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছয়। সরকার এর ফলে বাধ্য হয় হস্তক্ষেপ করতে। তারা পেট্রোল পাম্পগুলিকে পরিষ্কার বলে দেয়, পাম্পের দরজা খুলে রাখতে হবে। এবং তেল কম্পানিগুলিকে বলে, কোনও ভাবেই তেলাভাব ঘটানো চলবে না। পাম্পগুলিতে যাতে তেল থাকে, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের তরফে আশ্বাসবাণী দেওয়া হয়-- দেশে যথেষ্ট পরিমাণ তেল রয়েছে, চিন্তার কিচ্ছুটি নেই। পরিস্থিতি তার পর ভাল-র দিকে। আশা করা যাচ্ছে, জুলাই থেকে তেলের কোনও অভাব আর থাকবে না পাম্পগুলিতে।
ভারতের তেল সঙ্কটের কারণ কী ?
অপরিশোধিত তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গিয়েছে। টাকার দাম সেই সঙ্গে গিয়েছে কমে। তেল মার্কেটিং কোম্পানি যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এইচপিসিএল, বিপিসিএল এবং বেসরকারি সংস্থা নায়ারা এনার্জি, রিলায়েন্স এনার্জির মতো সংস্থা খুচরো বাজারে তেল বিক্রিতে ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর ফলে তারা তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়। পেট্রোলপাম্পগুলিতে তেল কম পাঠিয়েছে। পাম্পগুলিতে তাতেই হাহা-কার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আইওসিএলের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভাল অনেকটাই, কারণ তারা কম দামে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করেছে। তারা সরবরাহ একই রাখতে পারে এই ম্যাজিকেই। এই সংস্থার মার্কেটও বেড়েছে (কারওর পৌষমাস কারও সর্বনাশ, এ আর নতুন কি!)
সরকারের তরফে সমস্যাটি মেনে নেওয়া হয় ১৫ জুনের একটি নোটিশে। তারা বলে তেলের অভাব দেখা গিয়েছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো রাজ্যে। এ জন্য অবশ্য দোষ চাপানো হয় মূলত চাহিদা বৃদ্ধির ঘাড়ে। সরকার বলেছে, গত মাসের প্রথমাংশে গত বছরের তুলনায় তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ। সরকারের এমনও যুক্তি যে, সেই সমস্ত রাজ্যেই তেলের এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যেখানে বড় অঙ্কের তেল সরবরাহ করা হয়ে থাকে বেসরকারি সংস্থাগুলির রিটেল আউটলেটগুলি থেকে। এবং টার্মিনাল ডোপো ইত্যাদি, মানে যেখান থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে, তার সঙ্গে পাম্পগুলির দূরত্ব বেশি। সরকারের স্পষ্ট কথা, দেশে যে পরিমাণ পেট্রোল ডিজেল রয়েছে, তা যে কোনও ধরনের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করতে পারে। ভারতে ৮১,৭০০-র মতো তেল কেন্দ্র রয়েছে, এর মধ্যে ৭, ২০০-র মতো বেসরকারি মালিকানাধীন।
আরও পড়ুন Explained:সিঙ্গল-ইউজ প্লাস্টিকের দিন ফুরোল, কেন এবং কী ভাবে জানেন কি?
বেসরকারি মালিকানাধীন রিটেল আউটলেটগুলি কী সমস্যা?
পেট্রোল ও ডিজেলের দাম এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যাকে বলে ডি-কন্ট্রোলড। সরকারের দাম নির্ধারণে সরাসরি কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয় এতে। তবুও সরকারের অদৃশ্য হাত এই দাম নিয়ন্ত্রণে সব সময়তেই ব্যাপৃত থাকে। এই তো দিল্লিতে পেট্রোলের দাম হু-হু করে বাড়ছিল। ৩.৫৪ শতাংশ বেড়েছিল এপ্রিলে। মে মাসে শুল্ক হ্রাস করায় তা ৮.২৪ শতাংশ কমেছে। যা একই রয়েছে জুনে। এ দিকে কিন্তু অপরিশোধিত তেলের ওই দাম বৃদ্ধি। তাতেই তেল কোম্পানিগুলি ক্ষতির মুখে পড়ছে। বলা হচ্ছে, তেল কোম্পানিগুলির ক্ষতি ডিজেলে লিটার পিছু ২৫ টাকা এবং পেট্রোলে লিটার পিছু ১০ টাকা। এতে বেসরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা তাদের রিটেল আউটলেট থেকে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন Explained: ইউরোপকে গ্যাস রফতানিতে বড় কোপ, ইইউ-র ললাটে চরম চাপ, কী করবে তারা?
তা হলে সমস্যার সমাধান কী ?
আগামীতে তেলের দাম বৃদ্ধিতেই এই সমস্যার সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কারণ মুদ্রাস্ফীতিতে নাজেহাল সরকার। তেলের দাম এখন বাড়ানোর আগে একশো বার তাদের ভাবতে হবে। তেলের দাম বাড়লে মুদ্রাস্ফীতির ঝড়টা রোখা যাবে না কিছুতেই। সেই সঙ্গে এটাও বলতে হবে, যখন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে তলানিতে চলে গিয়েছিল, শূন্যে নেমে এসেছিল, তখন কিন্তু এখানে তেলের দাম কমেনি। সেটা তো বেশি দিন আগেরও ব্যাপার নয়। তখন তো বিপুল লাভ করেছিল তেল কোম্পানিগুলি, সরকারও পেয়েছিল বড় মাত্রায় সুফল। তা হলে এখন মুদ্রাস্ফীতির স্বার্থে একটু ক্ষতির মুখ দেখলে ক্ষতিটা কি! এই প্রশ্নটা অনেকেরই।