/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/06/fear-of-Disease.jpg)
হারিত্রী ও শীতলা
“আমি করোনাভাইরাসকে প্রতিদিন দেবী হিসেবে পুজো করছি, যাতে স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও যাঁরা ভাইরাস তৈরির জন্য পরিশ্রম করছেন, সেই বিজ্ঞানীরা ভাল থাকেন।” বললেন কেরালার কোল্লাম জেলার কাডাক্কালের এক মন্দিরের পুরোহিত অনিলন।
অনেকটা দূরে, উত্তর আসামের বিশ্বনাথ জেলার একদল মহিলা নদীতীরে জড়ো হয়েছিলেন করোনা মায়ের পুজোর জন্য। তাঁদের বিশ্বাস, এই মা সারা বিশ্বে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠা করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করবেন। ঝাড়খণ্ডের সিন্ধ্রি ও বোকারো থেকেও একই ছবি দেখতে পাওয়া গিয়েছে।
কেরালা, আসাম ও ঝাড়খণ্ডের এই ছবি দেখে সোশাল মিডিয়ায় অনেকে রেগে উঠেছেন বটে, তবে সভ্যতার শুরু থেকেই দুঃসময়ে বিশ্বাসের কাছে সমর্পণ করা মানবপ্রতিক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবেই থেকে গিয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯২৭ সালে তাঁর দেওয়া প্রখ্যাত ভাষণ ‘আমি কেন খ্রিষ্টান নই’-তে বলেছিলেন ভয়ই ধর্মের ভিত্তি।
“আমি মনে করি ধর্মের প্রথম ও মূল ভিত্তি ভয়। এর কিছুটা অজানার প্রতি ভয়, এবং কিছুটা যেমন আমি বলেছিস একটা মনোগত আকাঙ্ক্ষা যে একজন দাদা আপনার পাশে বিপদের ও সংকটের সময়ে পাশে থাকবে। ভয়ই হচ্ছে গোটাটার মূল ভিত্তি - রহস্যময়তাকে ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুভয়।”
ভয়ের খুব সাধারণ ধর্মীয় চেহারা হচ্ছে সর্পদেবতা। নিজের গবেষণাপত্র ‘Snakes: Objects of Religion, Fear, and Myth’-এ জোনাথন ডবলিউ স্ট্যানলি লিখছেন, "ইতিহাস জুড়ে মানুষের সঙ্গে সরীসৃপের সম্পর্ক অসহজ। জুডো-খ্রিষ্টান ঐতিহ্যে, হিন্দুধর্মে, মিশরিয় ও গ্রিক দর্শনে, আদি আমেরিকান ধর্মে সাপ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতগুলি ধর্মে সাপকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হল মানুষের সাপের ভয়।"
ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্যেও সাপকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে দেখা হয়ে থাকে।
ভয়ের সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগের আরেকটা বড় উদাহরণ যুদ্ধদেবতা। হিন্দুধর্মে ইন্দ্র ও কার্তিক যুদ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত, প্রাচীন রোমান ধর্মে মার্স হলেন যুদ্ধ দেবতা, বেশ কয়েকটি আফ্রিকান ধর্মে যুদ্ধের দেবতা হিসেবে আরাধ্য ওগুন।
রোগ ও তজ্জনিত ক্লেশের ভয়েরও বেশ কিছু ধর্মীয় প্রকাশ দেখা গিয়েছে। মানব ইতিহাসের প্রথম প্লেগ ঘটেছিল ষষ্ঠ শতাব্দীতে, তাকে দেবতার ক্রোধ বলে মনে করা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক ডুয়ান জে ওসহেইম তাঁর গবেষণা পত্র ‘Religion and epidemic disease’-এ লিখেছেন, “মহামারীর কোনও একটি বা আন্দাজ করা যায় এমন প্রতিক্রিয়া নেই। ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া সর্বদা রহস্য-উন্মোচক হবে, এ কথাও ধরে নেওয়া ঠিক নয়।”
“ধর্মকে লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতির মত বিশ্লেষণের একটা ক্যাটিগরি হিসেবে দেখাই ভাল। কোনও মহামারী রোগের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াকে একটা কাঠামো, ক্রমপরিবর্তনশীল একটা কাঠামো হিসেবে দেখাই ভাল, যা অসুস্থতা ও তাতে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে চলে।”
হারিত্রী- গুটিবসন্ত থেকে সন্তানদের রক্ষাকারী বৌদ্ধ দেবী
রোগ তাড়াতে প্রথম যে দেবীর কথা আমরা মূর্তিমাধ্যমে পেয়ে থাকি তা হারিত্রীর। খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকের দিকে কুষাণ রাজ বংশের রাজত্ব এলাকায় খননের মাধ্যমের হারিত্রীর বেশ কিছু মূর্তি মেলে। কুষাণরা গ্রিক-বৌদ্ধ ধর্মের উত্তরাধিকার বহন করত, যে কারণে তাদের মধ্যে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের হারিত্রীর জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়।
প্রথম গুটিবসন্তের প্রকোপ সম্পর্কে জানা যায় ইউরোপে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। ভারতে তা কবে প্রথম হয়েছিল তা জানা যায় না, তবে চৈনিক পর্যটক আই সিং ও জুয়ানজাং, যাঁরা ষষ্ঠ ও সপ্তপ শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন তাঁদের লেখায় উপমহাদেশের প্রতিটি বৌদ্ধ গুম্ফায় হারিত্রীর মূর্তির জনপ্রিয়তার উল্লেখ মেলে।
গুটিবসন্ত শিশুদের মধ্যেই বেশি দেখা য়ায় বলে মনে করা হত, লে কারণে হারিত্রীকে শিশুদের ভালমন্দ, শিশুজন্ম, শরীরের উর্বরতার জন্য যেমন পুজো করা হত, তেমনই আরাধনা করা হত শিশুরোগের প্রকোপ দূর করার জন্যও।
তবে পণ্ডিতেরা বলেছেন গ্রামীণ ও জনজাতির উপকথা থেকে বৌদ্ধ ঐতিহ্যে হারিত্রীর পূজা শুরু, অন্যদিকে গুটিবসন্তের দেবতার পূজা বহু আগে থেকেই চালু ছিল। ঐতিহাসিক শ্রীপদ্মা তাঁর গবেষণা Hariti: Village origins, Buddhist elaborations, and Saivite accommodations-য় বলেছেন, অন্ধ্রপ্রদেশের উপকথায় দেবী হারিত্রীর উৎসের সন্ধান মেলে, সে সময়ে তিনি দেবী এরুকাম্মা বলে পূজিত হতেন।
তিনি লিখছেন, “গুটিবসন্ত ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের দেবীরা অভিভাবক দেবী হিসেবে অন্ধ্রের সর্বত্র পূজিত হতেন। এই গুটিবসন্তের দেবী এলাকান্তরে বিভিন্ন নামে পরিচিত হতেন। কোথাও নাম ছিল মুতিয়ালাম্মা, কোথাও পোচাম্মা, কোথাও পেদ্দাম্মা, আবার কোথাও নুকালাম্মা বা আঙ্কালাম্মা।”
পদ্মার ব্যাখ্যায়, “কোনও কোনও গুটিবসন্তের দেবী ছিলেন সেইসব মহিলা, যাঁরা গর্ভবতী থাকাকালীন বা প্রসব করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। ভক্তরা মনে করতেন, এই মহিলাদের আত্মার যদি যথাযথভাবে পূজা না করা হয় তাহলে ওই আত্মারা তাঁদের সন্তানদের ধ্বংস ও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠবে।”
উপদেবতারা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ঐতিহ্যে গৃহীত হয়েছিলেন, যখন তাঁকে শিশু সুরক্ষা ও উর্বরতার দেবী হিসেবে মান্য করা হত। পুরাতাত্ত্বির প্রমাণাদি থেকে দেখা হিয়েছে যে হারিত্রী ১৫০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধপর্বে উদয় হন এবে ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এই দেবীর পূজা হতে থাকে।
বেলজিয়ামের পুরোহিত তথা বৌদ্ধ পণ্ডিত এনতিয়েন লামোতে তাঁর ১৯৮৮ সালের বই History of Indian Buddhism-এ লিখেছেন, "নেপালে এখনও এই দেবীকে গুটিবসন্ত থেকে আরোগ্যের জন্য পূজা করা হয় এবং বৌদ্ধ পুরোহিতরা তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যের ব্যবস্থা করবেন বলে প্রত্যাশা করা হয়।"
তিনি আরও বলেছেন “হারিত্রীর ছবি সর্বত্র লভ্য এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটি মেলে পেশওয়ারে। সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি একটি শিশুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, অন্য দুই শিশু তাঁর কাঁধে, এ ছবি একটি স্তম্ভে খোদিত রয়েছে, অজ্ঞাত কোনও এক যুগের ১৭৯ বা ১৩৯ বর্ষের এ ছবিতে দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে তিনি যেন গুটিবসন্তকে আকাশে মিলিয়ে দেন।”
শীতলা- গুটিবসন্তের দেবী
উনিশ শতকের মধ্যে ভারতের ব্রিটিশ চিকিৎসকরা সমস্ত মহামারীর মধ্যে গুটিবসন্তকে সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবের রোগ ও সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ বলে চিহ্নিত করেন। ঐতিহাসিক ডেভিড আর্নল্ড তাঁর Colonising the body: State medicine and epidemic diseases in nineteenth century India’ বইয়ে লিখেছেন, শুধু উনিশ শতকের শেষে গুটিবসন্তে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, প্রতি বছরে গড়ে কয়েক হাজার মানুষ এ রোগে মারা যান।
হিন্দু দেবী দুর্গার আরেক রূপ বলে মান্য শীতলা, বা কোথাও কোথাও শুধু মাতা নামে এই দেবী উনিশ শতকে বাংলা ও পূর্ব ভারতে গুটি বসন্ত থেকে আরোগ্য দেওয়ার জন্য পূজিত হতেন।
নৃতত্ত্ববিদ র্যালফ জে নিকোলাস তাঁর গবেষণাপত্র The Goddess Śītalā and Epidemic Smallpox in Bengal’-য় উল্লেখ করেছেন “দশম থেকে দ্বাদশ শতকের আগে গুটিবসন্তের দেবীর হদিশ পাওয়া যায় না, এবং আঠারো শতকে দক্ষিণপশ্চিম বাংলায় হঠাৎই তাঁর উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণভাবে নজরে পড়ে।”
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের উপকথা অন্যান্য অনেক গুটিবসন্তের দেবীর উল্লেখ পাওয়া গেলেও শীতলার অবস্থান ছিল বিশেষ। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল একদিকে তিনি যেমন দেবী হিসেবে পূজিতা হচ্ছেন, তেমনই গুটিবসন্তকে মনে করা হচ্ছে তাঁরই রূপ।
ডেভিড আর্নল্ড লিখছেন, “প্রবল জ্বর ও গায়ের গুটি শরীরে তাঁর প্রবেশের সূচনাকারী ছিল এবং তার মোকাবিলায় চিকিৎসার চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হত আচারে। অনেক হিন্দুই বিশ্বাস করতেন এর চিকিৎসা করলে যে শিশুর শরীরে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন তার ক্ষতি হবে।”
শীতলা এসছে শীতল শব্দ থেকে। শীতলাকে শান্ত করার জন্য দই, ঠান্ডা ভাত, মিষ্টি, কলার মত ঠান্ডা জিনিস দেওয়া হত। আর্নল্ডের ব্যাখ্যায়, “একইভাবে যখন গুটিবসন্তের আক্রমণ হত, তখন রোগীকে ঠান্ডা পানীয় দেওয়া হত, এবং রোগীর জ্বরতপ্ত শরীর ঠান্ডা জলে ধুইয়ে দেওয়া হত বা শীতলার প্রিয় নিমগাছের পাতা শরীরে বুলিয়ে দেওয়া হত।”
১৯৭০-এর দশকে ভারত থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হয়ে গেলেও দেশের বহু অংশে এখনও তাঁর পূজা হয়ে থাকে।
কলেরার দেবী ওলা চণ্ডী/বিবি
উনিশ শতকে ভারতের আর এক ভয়াবহ মহামারী ছিল কলেরা। যদিও খ্রিষ্টপূর্ব চার শতক থেকে হিন্দু, আরব, চৈনিক, গ্রিক ও রোমান চিকিৎসাশাস্ত্রে কলেরার উল্লেখ পাওয়া গেলেও উনিশ শতকে এই মহামারী চূড়ান্তরূপ নেয় যখন সারা বিশ্বে কলেরায় প্রাণ যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের।
১৮১৭ সালের মহামারীর পর থেকে কলেরার আচার পালিত হওয়া শুরু হয় বলে মনে করা হয়। আর্নল্ড লিখছেন, “কেবলমাত্র বদ্বীপ বাংলায়, কলেরার নির্দিষ্ট দেবী রূপ ছিল, মুসলিমরা বিশ্বাস করতেন ওলা বিবিতে, হিন্দুরা পূজা করতেন ওলাই চণ্ডীকে।”
তিনি আরও লিখেছেন, “১৮১৭ সালের আগে শীতলার চেয়ে এই দেবী কম জনপ্রিয় ছিলেন,কিন্তু কলেরার প্রাদুর্ভাব সে মরশুমে ব্যাপক হওয়ায় ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীর আরাধনার বাড়বৃদ্ধি ঘটে।”
আর্নল্ডের বইয়ে উদ্ধৃত ইউরোপিয় মিশনারিদের রিপোর্ট থেকে মনে হয়, কোনও কম বয়সী মেয়েকে এই দেবী রূপে কল্পনা করা হত। বাংলা ছাড়া রাজস্থানেও এই দেবীর পুজো হত, যেখানে তিনি ভক্তদের কলেরা, জন্ডিস, ডায়েরিয়া ও অন্যান্য পেটের রোগ থেকে রক্ষা করতেন।
এ ছাড়াও রোগের ভয় থেকে আরও কিছু দেবতার আরাধনার প্রচলন ছিল, যেমন চর্মরোগের জন্য ঘেঁটু দেবতা ও রক্তে সংক্রমণের জন্য রক্তবতী দেবী।
ভয়ের কারণে ধর্মের আশ্রয় নেওয়া মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক যেমন, তেমনই তা মুছে ফেলতেই বিজ্ঞানের হস্তক্ষেপ শুরু। রাসেল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দিতে পারে, আমি মনে করি আমাদের হৃদয়ও আমাদের শিক্ষা দিতে পারে যে আমাদের আর কল্পিত আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই, আমাদের বন্ধু খুঁজতে আকাশে হাত বাড়াতে হবে না, আমরা বরং নিজেদের প্রচেষ্টার দিকেই মন দিতে পারি, যাতে এ জগৎ বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।”