রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার এক মাস হতে চলল। বেশ রাউন্ড আলোচনা চলেছে দু'দেশের মধ্যে, কিন্তু এখনও অস্পষ্ট যুদ্ধের সমাপ্তির ঘণ্টাটা কী করে বাজবে! নেটোয় যোগ দিচ্ছে ইউক্রেন, সেই আশঙ্কা থেকেই রাশিয়ার এই হামলা। যা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন প্রায় সকলেই। ইউক্রেনের নেটো-যোগ মানে রাশিয়ার ঘাড়ের উপর আমেরিকার নিঃশ্বাস ফেলা। যে ইউক্রেনের উপর এই সেদিনও রাশিয়ার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিল, সে দেশের প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার কথায় উঠতেন বসতেন, সেইটি আমেরিকার ক্ষমতার বলয়ে চলে যাবে নেটোর হাত ধরে, তা মানতে পারেননি রুশ প্রেসিডেন্ট। কী করেই বা মানবেন, তাই না! ইউক্রেন তো এককালে রাশিয়ার অংশ এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে বারবার ইউক্রেনে আন্দোলন হলেও একটা সময় পর্যন্ত সেখানকার একটা বড় অংশই ছিল রাশিয়ার পক্ষে। এখন সে দিন গিয়াছে। পরিস্থিতি এখন পুরো উল্টো গতিতে, রাশিয়ার দিক থেকে জনগণের হাওয়া ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু কেন? এর জন্য দায়ী পুতিনের দেশই। ক্রিমিয়া উপদ্বীপ পুতিন ইউক্রেনের থেকে দখল করে নেওয়ার পর থেকেই নেটো নিয়ে সে দেশের জনসাধারণের মত বদল হতে থাকে। ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত যে নেটো সমর্থন ছিল নীচের দিকে, তা-ই ২০১৪-এ রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। ২০১৭ সালের গণভোটে তো ৬৯ শতাংশে পৌঁছয় এই নোটো-সমর্থন ( ২০১২ সালে যা ছিল ২৮ শতাংশ, সে সময় ইউক্রেনের মসনদে ছিলেন ইনুকোভিক, যিনি ছিলেন পুরোমাত্রায় রুশপন্থী)। রাশিয়া নিজের ভুলটা না বুঝতে পেরে ইউক্রেন হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে তাদের পুরোপুরি দখল করতে চেয়ে আরও বড় ভুল করে ফেলেছে। খলের ছলের অভাব হয় না। ফলে এমনও অজুহাত শোনা গিয়েছে যে, এক সময় ইউক্রেন তাদেরই অংশ ছিল, হারানো অংশকে জোড়ার মধ্যে তো অপরাধ কিছু নেই! বরং সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রবল শক্তিধর রাশিয়ার এই হামলা অবশ্য ইউক্রেনের নেটো-যোগের স্বপ্ন ছুটিয়ে দিয়েছে, বলছেন অনেকে। কারণ কয়েক দিন আগে জেলেনস্কিকে একবার বলতে শোনা গিয়েছিল, 'নেটোর অংশ হবে না ইউক্রেন'। যদিও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের এই অবস্থান নিয়ে বিস্তর ধন্দ তৈরি হয়েছে। কারণ, গতকাল সে দেশের একটি পোর্টাল খবর করেছে, প্রেসিডেন্ট নাকি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে নেটো, তাই তাদের হয়ে লড়ছে না। নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন মানে নেটো বলে দিক, তারা ইউক্রেনকে সঙ্গে নেবে না রাশিয়াকে ভয় করে চলবে। স্পষ্ট ভাষায় নাকি বলেছেন জেলেনস্কি। তবে জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি তৈরি। এখন কথা হল, আলোচনায় তো 'নেটোয় যোগ দেব না' বলতে হবে, সরাসরি না হলেও ঘুরিয়ে। তা ছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী দুই এলাকা লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক কি রাশিয়াকে ছেড়ে দেবেন জেলেনস্কি? সেই প্রশ্নও থাকছে। জেলেনস্কি কিন্তু এ ব্যাপারেও অনড় মনোভাব দেখাচ্ছেন এখনও। পাশাপাশি, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে ইউক্রেনের সঙ্গে রুশ সম্পর্কে ফিনল্যান্ডাইজেশনের তত্ত্ব তুলে ধরছেন। তার বলছেন, ইউক্রেন ফিনল্যান্ডাইজেশনে না গেলে যুদ্ধ থামবে না।
ফিনল্যান্ডাইজেশন কী?
এর গোদা অর্থ হল, কোনও দেশ যদি বেশি শক্তি রাখে, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তার কোনও প্রতিবেশী দেশ দেশটির কর্তৃত্ব পরোক্ষে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু কম শক্তি থাকা দেশটির অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ ভাবে সেই শক্তিশালী দেশ মাথা গলাবে না। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে ফিনল্যান্ড এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা কয়েক দশকের ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ হয়েছিল একটি চুক্তিতে। যা এই ফিনল্যান্ডাইজেশনের ওই তত্ত্বে সিলমোহর। চুক্তির সামান্য বিশদে গেলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রথমত বলা হয়, যদি ফিনল্যান্ড অথবা ফিনল্যান্ডের এলাকার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনও ভাবে জার্মানি কিংবা তাদের কোনও সঙ্গী (মানে, আমেরিকা) হামলা করে, তা হলে ফিনল্যান্ড স্বাধীন দেশ হিসেবে হামলা প্রতিহত করবে। আর দ্বিতীয়, ফিনল্যান্ড হামলার মুখে পড়লে প্রয়োজন হলে রাশিয়ার সাহায্যে কিংবা তাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে হামলা রুখবে।
ফিনল্যান্ডাইজেশন মানে, তুমি দাদা মেনে নেব, কিন্তু ভাইয়ের স্বাধীনতা যেন থাকে। দেখা যাক কোন পথে এগিয়ে যায় গোটা ব্যাপারটা। কে না জানে যুদ্ধবিরতি না হলে সঙ্কটের সতেরো। এর মধ্যেই তো এ দেশের বাজার দাউ-দাউ জ্বলছে যুদ্ধের আঁচে। শান্তির ললিত বাণী ব্যর্থ পরিহাস শোনালে এখন আর চলবে না কিছুতেই।
Read story in English