Advertisment

ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কী ভাবে কাজ করে

আসাম এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা ১৫ জুলাই। বিদেশি বলে ট্রাইবুনাল দ্বারা নির্ধারিত হয়েছেন বহু মানুষ, অনেকের আবেদন এখনও ঝুলছে। এঁরা ঠাঁই পাচ্ছেন ডিটেনশন ক্যাম্পে। ফরেনার্স ট্রাইবুনাল ঠিক কী পদ্ধতিতে কাজ করে, দেখে নিন এই বিশ্লেষণে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Assam NRC, Foreigners Tribunal

১০০ ফরেনার্স ট্রাইবুনাল রয়েছে আসামে

গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জিকে রেড্ডি সংসদে বলেছেন ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আসামের ফরেনার্স ট্রাইবুনাল একপাক্ষিক ভাবে ৬৩, ৯৫৯ জনকে বিদেশি ঘোষণা করে। অর্থাৎ এই ঘোষণার সময়ে এঁরা উপস্থিতই ছিলেন না। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হলফনামায় এবং এ বছর বিধানসভায় জমা দেওয়া তথ্যানুসারে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল ১৯৮৫ থেকে অগাস্ট ২০১৮-এর মধ্যে ১,০৩,৬৭৪ জনকে বিদেশি ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬৩,৯৫৯ জনের নাম যাঁদের একপাক্ষিক ভাবে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে।

Advertisment

ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কীভাবে কাজ করে?

আসামের বেআইনি উদ্বাস্তুদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে এই সংস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ১৫ জুলাই যে অন্তিম এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস) প্রকাশিত হতে চলেছে, তার জেরে এ সংস্থা এখন সকলের নজরে। এখন ১০০ ফরেনার্স ট্রাইবুনাল রয়েছে। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে আরও ২০০ ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কার্যকর হবে। এটি একটি আধা বিচারবিভাগীয় সংস্থা। এদের কাজ হল ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুসারে কোনও ব্যক্তি বিদেশি কিনা তা নির্ধারণ করা। ১৯৬৪ সালে কেন্দ্র ফরেনার্স (ট্রাইবুনাল) আদেশ জারি করে। আইনের তিন নং ধারায় ওই নির্দেশ জারি করা হয়। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে দু ধরনের বিচার হয়ে থাকে। প্রথমত সীমান্ত পুলিশ যাদের নাম উল্লেখ করে এবং ভোটার তালিকায় যাদের নাম ডি (সংশয়জনক) ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

কী পরিস্থিতিতে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল একপাক্ষিক আদেশ দিয়ে থাকে?

ফরেনার্স অ্যাক্টের ৯ নং ধারানুসারে কোনও ব্যাক্তি বিদেশি কি না তা প্রমাণ করার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপরেই বর্তায়। ফরেনার্স ট্রাইবুনালের এক প্রাক্তন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলছিলেন, যেহেতু এই প্রমাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপরেই বর্তায়, ফলে তিনি যদি ট্রাইবুনালে উপস্থিত না হন বা পলাতক হন, তাহলে ট্রাইবুনালের সদস্য একপাক্ষিক ভাবেই নির্দেশ দিতে পারেন।

এর আগে ১৯৮৩ সালের বেআইনি উদ্বাস্তু (ট্রাইবুনাল কর্তৃক নির্ধারিত) আইন অনুসারে কোনও ব্যক্তির জাতীয়তা প্রমাণের দায় থাকত অভিযোগকারীর উপর। ২০০৫ সালে সর্বানন্দ সোনোয়াল বনাম ভারত যুক্তরাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ওই আইন বাতিল করে দেয় এবং বলে যে এই আইনের জন্য বেআইনি উদ্বাস্তুদের চিহ্নিত করেত এবং তাদের বিতাড়ন করতে সমস্যা হচ্ছে।

কোন পরিস্থিতিতে একপাক্ষিক নির্দেশ জারি করা হয়?

সুপ্রিম কোর্টে এ বছর এপ্রিল মাসে এক হলফনামায় আসাম সরকার বলে যে বিদেশি মামলায় যখন কেউ জানতে পারেন যে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে তদন্ত চলছে তখন তিনি অন্য জায়গায় চলে যান, এবং তাঁর হদিশ পাওয়া যায় না। এরকম ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের পক্ষে একপাক্ষিক উপায়ে রায় দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ওই হলফনামায় আরও বলা হয়েছে যে সন্দেহভাজন বিদেশিরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে নোটিস পেয়ে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের সামনে হাজিরা দেন, কিছু নথি ও লিখিত বিবৃতিও দেন তাঁরা, কিন্তু পরবর্তী তারিখগুলিতে তাঁরা আর হজির হন না।

আসাম সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল. যখন দেখা যায় যে দীর্ঘ সময় ধরে কেউ অনুপস্থিত, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দেওয়া বিবৃতি ও নথির ভিত্তিতে মামলার মীমাংসা করা হয়। এসব কারণেই ফরেনার্স ট্রাইবুনালে বেশ বড় সংখ্যক মামলার একপাক্ষিক ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

কিন্তু অভিযু্ক্ত ব্যক্তি হাজিরা দেওয়া বন্ধ করে দেন কেন?

ফরেনার্স ট্রাইবুনালের মুখোমুখি য়াঁরা হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের পরিবার এবং তাঁদের আইনজীবীরা এ প্রসঙ্গে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল নোটিস অভিযুক্তের কাছে পৌঁছয়ই না। আইনজীবী আমন ওয়াডুড গৌহাটি হাইকোর্ট এবং ফরেনার্স ট্রাইবুনালে বহু অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করে থাকেন। তিনি বলছিলেন, ধরুন একটা নোটিস পাঠানো হল এক নির্মাণকর্মীর নামে, একটা ভাড়া বাড়িতে, যেথানে তাঁর সম্পর্কে আসাম পুলিশের সীমান্ত শাখা তদন্ত করেছিল বেশ কয়েক মাস আগে। তিনি অন্য জেলায় অন্য নির্মান ক্ষেত্রে চলে গিয়েছেন - সেক্ষেত্রে তিনি নোটিস হাতেই পাবেন না এবং জানতেও পারবেন না যে কীভাবে ট্রাইবুনালে হাজিরা দিতে হয়।

অধিকাংশ মামলাতেই পুলিশ অভিযুক্তকে ট্রাইবুনালের নোটিস পাঠায়ই না - যার ফলে এই সব ব্যক্তিরা তাঁদের অজ্ঞাতেই বিদেশি বলে ঘোষিত হয়ে যান। কিছু ক্ষেত্রে নোটিস পাওয়া সত্ত্বেও অনেকে কয়েকবার ট্রাইবুনালে হাজিরা দেওয়ার পর দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং পদ্ধতির জটিলতার জন্য আর উপস্থিত হন না। বেশ কিছু এমন মামলাও রয়েছে যাতে আইনজীবীরা ভুল পরামর্শ দেওয়ায় অভিযুক্তরা হাজিরা দেন না।

সরকারি হলফনামায় নোটিস পাঠানোর পদ্ধতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, যে অনেক মামলায় অভিযু্ক্ত ব্যক্তি নোটিস গ্রহণ করতে চান না ফলে অন্য পদ্ধতিতে নোটিস জারি করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। হলফনামায় বলা হয়েছে, তেমন ক্ষেত্রে একপাক্ষিক ভাবে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে।

১৯৬৪ সালের ফরেনার্স ট্রাইবুনাল নির্দেশের ৩এ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইবুনাল যদি একপাক্ষিকভাবে রায় দেয় এবং যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাজিরা না দেওয়ার সপক্ষে যথাযথ কারণ থাকে, তাহলে তিনি ওই নির্দেশের ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে পারবেন। যদি তেমন হয় তাহলে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল একপাক্ষিক ওই নির্দেশ বাতিল করে যথাযথ ভাবে মামলা চালাতে পারেন। এই আইনের বলে ৩০ দিন পরে কোনও আবেদন করা হলে তা নামঞ্জুর করতে পারে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। আইনজীবীরা এও বলেছেন যদি একবার একপাক্ষিক নির্দেশ জারি হয়ে যায়, তাহলে সংশ্লিষ ব্যর্কি ৩০ দিনের মধ্যে সে কথা জানতেই পারবেন না।

অভিযুক্ত ব্যক্তি কি একপাক্ষিক আদেশের বিরুদ্ধেে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন?

সরকারি হলফনামায় বলা হয়েছে- এই নির্দেশ ফরেনার্স ট্রাইবুনাল রিভিউ করতে পারে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর অনুপস্থিতির যথাযথ কারণ দেখাতে পারেন অথবা মামলা ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনও খবর না থাকে এবং এই নির্দেশের বিষয়ে যদি তিনি কিছু না জেনে থাকেন।

৯ নং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩ নং ধারানুসারে রিভিউয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে যদি আদালতের সমন পাঠানো নিয়ে কেউ অসন্তুষ্ট হন এথবা শুনানির সময়ে হাজির না হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের নির্দেশ বাতিল করে দিতে পারে আদালত।

প্রাক্তন এক ট্রাইবুনাল সদস্যের মতে, বেশি আইনজীবী এই ধারার সুযোগ নেন না। গুয়াহাটির এক আইনজীবী বলেন, রিভিউয়ের জন্য আবেদন বেশি আইনজীবীরা করেন না, কারণ সেদিনই যদি পূর্ববর্তী নির্দেশ বাতিল না হয়ে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ওইদিনই গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারির ঝুঁকি এড়ানোর জন্যই বেশ কিছু আইনজীবী মামলার চূড়ান্ত দিনে আদালতে হাজিরা থেকে মক্কেলদের বিরত থাকতে বলেন।

একপাক্ষিক নির্দেশে রিভিউ না করা হলে অথবা রিভিউয়ের আবেদন বাতিল হয়ে গেল কী হবে?

পুলিশ যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সন্ধান পায় তাহলে তাঁকে গ্রেফতার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। তা না হলে উক্ত ব্যক্তিকে নিখোঁজ বিদেশি বলে বিবেচ্য হবেন। অনেক ঘোষিত বিদেশি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন। একপাক্ষিক নির্দেশ ও যে সব ক্ষেত্রে পুনর্বিচারের আবেদন করা হয়েছে কিন্তু শুনানি স্থগিত রয়েছে, তেমন অনেক মামলার জেরে বহু মানুশ আসামের ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন।

Assam nrc
Advertisment