Advertisment

Explained: পুলিশের বুলেটবৃষ্টি, তার মধ্যেও পতাকা উঁচু করে এগিয়ে গিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী

অল্পবয়সেই বিধবা হয়েছিলেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
malda district got independence on 18th august 1947

মাতঙ্গিনী হাজরাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে 'গান্ধীবুড়ি' বলা হয়।

প্রথম গুলিটা লেগেছিল তাঁর বাম হাতে। থরথর করে শরীরটা কেঁপে উঠলেও দেশের পতাকা মাটিতে স্পর্শ করতে দেননি। ডানহাত থেকে শাঁখ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। গুলিবিদ্ধ বাম থেকে ডান হাতে তুলে নিয়েছিলেন পতাকা। তুলে নিয়েছিলেন শাঁখও। উঁচুতে তুলে ধরে বলেছিলেন, 'বন্দে মাতরম'। এবারে গুলি লেগেছিল তাঁর ডান হাতে। মাটিতে বসে পড়েছিলেন। সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতই সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন জাতীয় পতাকা। ব্রিটিশ পুলিশের তাতেও করুণা জন্মায়নি। ৭৩ বছরের বৃদ্ধার কপাল লক্ষ্য করে গুলি করেছিল পুলিশ। আর, সেই ব্রিটিশ পুলিশরা ছিলেন এদেশেরই বাসিন্দা। এর পরে ক্ষীণ কন্ঠে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি দিয়ে দেশমাতৃকার কোলে চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। তাঁর রক্তের লাল ফোঁটায় ভিজে গিয়েছিল এদেশের মাটি।

Advertisment
publive-image

মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ও পরিবার
সালটা ছিল ১৮৬৯, তারিখ ১৭ নভেম্বর। তমলুকের কাছে হোগলা গ্রামের মাইতি পরিবারে জন্ম মাতঙ্গিনী হাজরা। অবশ্য ইতিহাসবিদদের মধ্যে তাঁর সঠিক জন্ম-তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলেন, সালটা ছিল ১৮৭০। তাঁর বাবার নাম ছিল ঠাকুরদাস মাইতি। মা ভগবতী দেবী। মাতঙ্গিনী ছিলেন পরিবারের ছোট মেয়ে। ডাক নাম ছিল, 'মাতু'। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর বাবা ঠাকুরদাস আদরের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন পাশের গ্রাম আলিনানের সম্পন্ন কৃষক বছর ৬০-এর ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে। সেটা ছিল ত্রিলোচন হাজরার দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় ত্রিলোচন হাজরা মারা যান। নিঃসন্তান অবস্থায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিধবা হন মাতঙ্গিনী হাজরা। এরপর সংসারের কোন্দলে স্বামীর ঘরে তিনি আর জায়গা পাননি। আশ্রয় নেন পাশের এক জমিতে ঝুপড়িতে।

সমাজসেবার সূত্রে কংগ্রেসে যোগাযোগ
সেখানেই ধান ভাঙানোর কাজ করে জীবন চালিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দর ভক্ত ছিলেন। স্বামীজির বক্তব্যের একটি লাইন তাঁকে ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিল, তা হল- 'এখন থেকে আগামী পঞ্চাশ বছর তোমাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা হবেন জননী-জন্মভূমি। তাঁর পুজো কর সকলে।' সেই কথা মাথায় রেখে তিনি 'জনসেবা'য় ঝাঁপিয়ে পড়েন। চেনা-অচেনা বহু মানুষ তাঁর সেবায় উপকৃত হয়। এভাবেই একসময় তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল পাশের সিউরি গ্রামের কংগ্রেস নেতা বিজ্ঞানী মণিলাল ভৌমিকের বাবা গুণধর ভৌমিকের সঙ্গে। সেই সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশ সামন্তদের মত নেতাদের সঙ্গে।

'গান্ধীবুড়ি' নামে পরিচিতি
তাঁদের মুখেই মাতঙ্গিনী শুনেছিলেন গান্ধীজি, তাঁর আদর্শ, ভাবনা এবং আন্দোলনের কথা। তারপর থেকে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে মাতঙ্গিনী হাজরা গান্ধীজির কথা, তাঁর আদর্শের কথা প্রচার করেছিলেন। সঙ্গে পীড়িত মানুষের সেবায় মনোনিবেশ করেছিলেন। যা দেখে লোকে তাঁর নামই দিয়েছিল 'গান্ধীবুড়ি'। এরপর ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের বিভিন্ন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বহু সভা এবং সমিতি আর সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। লবণ সত্যাগ্রহ, সরকারি কর বন্ধ করে আন্দোলন, আদালতে ভারতের পতাকা তোলা, লাটসাহেব'কে কালো পতাকা দেখানো- সবেতেই যোগ দিয়েছেন। পুলিশের নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছেন। বিভিন্ন সময় জেল খেটেছেন। তার মধ্যে বহরমপুর কারাগারে ছিলেন ছয় মাস বন্দি। হিজলি বন্দি নিবাসে ছিলেন দুই মাস।

২৯ সেপ্টেম্বরের আন্দোলন
১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, বেলা তিনটে। 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের জোয়ার তখন মেদিনীপুরে আছড়ে পড়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ঠিক করেছেন, একসঙ্গে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রাম থানা আক্রমণ করে দখল করে নেবেন। মাতঙ্গিনী হাজরা মাতঙ্গিনী স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন গাছ ফেলে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কেটে দিতে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে। পাঁচ দিক থেকে পাঁচটি মিছিল নিয়ে তমলুক থানা এবং সমস্ত সরকারি অফিস দখল করতে। তার মধ্যে উত্তর দিকের মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মাতঙ্গিনী নিজে।

পুলিশের মুখোমুখি জনতা
তমলুক শহরের উত্তর দিকের গ্রাম হোগলা, আলিনান, জ্যামিট্যা, সোয়াদিঘি, খোসখানা, ডিমারি, বিশ্বাস, ধলহারা, মথুরি, সিউরি থেকে দলে দলে মানুষ রূপনারায়ণ নদের পাড় ধরে মিছিলে হেঁটে আসছিলেন। পায়রাটুঙ্গি খালের কাছে দেওয়ানি কোর্টের পিছনে বিশাল ব্রিটিশ পুলিশবাহিনী মিছিলের গতিরোধ করে। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। হঠাৎই মথুরি গ্রামের ১৩ বছরের বালক লক্ষ্মীনারায়ণ দাস ছুটে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ব্রিটিশ পুলিশ মিছিলের সামনে সেই বালককে বন্দুকের বাঁট দিয়ে থেঁতলে খুন করে।

আরও পড়ুন- বাংলার দুর্ভিক্ষ কীভাবে বদলে দিয়েছিল ভারতের ‘সবুজ বিপ্লবের জনক’ স্বামীনাথনের জীবন?

দিশাহারা মিছিল সামলান মাতঙ্গিনী
সেই সময় মিছিল যখন দিশাহারা, এগিয়ে আসেন ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা। ভীত মিছিলের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, 'থানা কোন দিকে? সামনে, না পিছনে? কেউ পিছিয়ে যেও না, এসো। আর যদি কেউ না-আস, তবে আমি একাই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাব। তাতে যদি মরতে হয় মরব।' ব্রিটিশ পুলিশের তৃতীয় গুলিটা তাঁর বাম চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বরের সেই দিন মাতঙ্গিনী হাজরা ছাড়াও ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে তমলুকের মাটিতে শহিদ হয়েছিলেন মথুরি গ্রামের লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, দ্বারিবেরিয়ার পুরীমাধব প্রামাণিক, মাশুরির জীবনকৃষ্ণ বেরা, আলিনানের নগেন্দ্রনাথ সামন্ত, ঘটুয়ালের পূর্ণচন্দ্র মাইতি, তমলুকের নিরঞ্জন জানা, কিয়াখালির রামেশ্বর বেরা, হিজলবেড়িয়ার নিরঞ্জন পাখিয়াল, খনিকের উপেন্দ্রনাথ জানা ও ভূষণচন্দ্র জানা এবং নিকাশির বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী-সহ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।

Mahatma Gandhi Britain Medinipur Tamluk Matangini Hazra Freedom Struggle
Advertisment