কানাড়া ব্যাংকের সঙ্গে ৫৩৮ কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগে একটি তহবিল তছরুপ মামলায় শুক্রবার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তাঁকে গ্রেফতার করেছেন। নরেশ গোয়েল, সাধারণ কেউ নন। zee কোম্পানির অন্যতম শীর্ষকর্তা থেকে ভারতীয় বিমান পরিবহণের একসময়ের পোস্টার বয়। ৭৪ বছরের গোয়েল একসময় জেট এয়ারওয়েজকে একটি বিশ্বমানের বিমান সংস্থা হিসেবে তুলে ধরেছেন। পরে, অবশ্য সেই সংস্থার পতনও তাঁকে দেখতে হয়েছে। তারপরও বলা যায়, গোয়েলের পদক্ষেপ ভারতের বিমান পরিবহণকে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পথ দেখিয়েছে। আর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সরকার এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর প্রভাব? এককথায় তুলনাহীন।
পঞ্জাব থেকে দিল্লিতে
১৯৪৯ সালে জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে পঞ্জাবে। প্রথমে সাংরুর, পরে পাতিয়ালায়। গোয়েল পরিবার চরম আর্থিক সংকটের পর ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে সাংরুর থেকে পাতিয়ালায় চলে আসে। তাঁদের আত্মীয় শেঠচরণ দাস ছিলেন পাতিয়ালার একজন বড় ব্যবসায়ী। তিনি সেই কঠিন সময়ে গোয়েল পরিবারকে সাহায্য করেছিলেন।
ট্রাভেল এজেন্টের জীবন
আর, তাঁরই হাত ধরে ভ্রমণ শিল্পে গোয়েলের প্রবেশ। ১৯৬৭ সালে, গোয়েল দিল্লিতে দাসের ট্রাভেল এজেন্সির হয়ে কাজ করা শুরু করেন। শেঠচরণ দাসের ট্রাভেল এজেন্সি লেবানিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিক্রয় এজেন্টের দায়িত্বে ছিল। পরবর্তী ছয় থেকে সাত বছরে, গোয়েল ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায় মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং ইরাকি এয়ারওয়েজ ও রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারলাইন্সের মত বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ভ্রমণ ও বিমান ব্যবসার গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ওই সব বছরগুলো তিনি ব্যবসার জন্য নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। বিমান পরিবহণ ব্যবসার খুঁটিনাটি শেখেন।
শুরু নিজের ব্যবসা
১৯৭৪ সালে গোয়াল তাঁর নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। চালু করেন জেটায়ার (প্রাইভেট) লিমিটেড। ভারতে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর টিকিট বিক্রয় এবং বিপণনের দায়িত্ব পান তাঁর সংস্থা। গোয়েলের কোম্পানি এয়ার ফ্রান্স এবং ক্যাথে প্যাসিফিক-সহ ভারতে কিছু বিদেশি বিমান সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।
জেট এয়ারওয়েজ
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতীয় অর্থনীতিতে উদারনীতির সূচনা গোয়েলের জীবনে বড় পরিবর্তন আনে। সরকার তার মুক্ত আকাশ নীতিতে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোকে পরিষেবা দেওয়ার অনুমতি দেয়। জেট এয়ারওয়েজ চালু হয়। ১৯৯৩ সালের মে মাসে বাণিজ্যিক পরিষেবা শুরু করে। তখন এটি গাল্ফ এয়ার এবং কুয়েত এয়ারওয়েজের সাহায্যে চলত। এই দুই সংস্থার একসঙ্গে ৪০ শতাংশ শেয়ার ছিল জেট এয়ারওয়েজে।
মুক্ত আকাশ নীতি
সেই সময়ে আরও কয়েকটি অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থা- ইস্ট-ওয়েস্ট এয়ারলাইনস, দামানিয়া এয়ারওয়েজ, সাহারা ইন্ডিয়া এয়ারলাইনস এবং মোদীলুফত তৈরি হয়েছিল। সাহারা ছাড়া বাকি তিনটি বিমান সংস্থা পরে ভারতীয় বিমান চলাচলের মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর, সাহারা পরে এয়ার সাহারা নামকরণ করে ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে। জেট এয়ারওয়েজ সরকারি মালিকানাধীন বিমান সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস এবং এয়ার ইন্ডিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। এর পিছনে সরকার এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে গোয়েলের প্রভাব অনেকাংশে কাজ করেছে। শুধু তাই নয়, জেট এয়ারওয়েজের দ্রুত উত্থানও ঘটেছে।
আরও পড়ুন- হাল খারাপ! ঋণে জর্জরিত দেশগুলো, কী অবস্থা ভারতের?
টাটার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা
এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির বেশ কয়েকজন মাথা বিশ্বাস করেন যে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে টাটা গ্রুপ এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মধ্যে একটি প্রস্তাবিত বিমান পরিবহণের যৌথ-উদ্যোগ ভেঙে দেওয়ার পিছনে গোয়েলের হাত ছিল। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে, যখন সরকার এয়ার ইন্ডিয়ার অংশীদারিত্বকে আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছিল, তখন টাটা গ্রুপ এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স যৌথভাবে জাতীয় বিমান সংস্থার ৪০ শতাংশ শেয়ার নেওয়ার কাছাকাছি ছিল। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর হইচই গোটা প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে হতাশ টাটা গ্রুপ প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে। সেই সময় রটেছিল যে গোয়েল পরদার আড়াল থেকে টাটা-সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ভারতীয় আকাশে প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য কলকাঠি নেড়েছিলেন।