বৃহস্পতিবার দু ঘণ্টা ধরে অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোগপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৈঠকের পর ৪২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন নমিনাল জিডিপি হারের পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেছেন, ভারতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তির শক্তি যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে তাতে তার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, পর্যটন, নগরোন্নয়ন, পরিকাঠামো ও কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবার এবং কর্মসসংস্থানের ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে।
প্রথানমন্ত্রীর বৈঠক ও বিবৃতি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এ ধরনের বক্তব্য রাখা হয় কেন্দ্রীয় বাজেটের সময়ে, যে বাজেট পেশ করা হবে ১ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয়ত, ভারতের অর্থনীতি এখন বেহাল।
বর্তমান আর্থিক বর্ষে জাতীয় আয়ের যে প্রথম আগাম অনুমান কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে নমিনাল জিডিপি ২০১৯-২০ সালে ৭.৫ শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের পর থেকে এই অঙ্ক সর্বনিম্ন। নিমনাল জিডিপি বৃদ্ধির হার থেকে মুদ্রাস্ফীতির হার বাদ দিয়ে প্রকৃত জিডিপির হিসেব করা হয়ে থাকে। ফলে যদি ধরে নেওয়া হয় এই আর্থিক বর্ষে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪ শতাংশ, তাহলে প্রকৃত জিডিপি হবে ৩.৫ শতাংশ।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে যে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করা হয়েছিল, তাতে অনুমান করা হয়েছিল প্রকৃত জিডিপির বৃদ্ধি হবে ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশ। ৪ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ধরে নিয়ে নমিনাল জিডিপি বৃদ্ধির হার ১২ থেকে ১২.৫ শতাংশ হবে বলে মনে করা হয়েছিল।
'অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত'- এ কথার তাৎপর্য কী?
এর আগে যখনই অর্থনীতির দশা বেহাল হয়েছে, তখনই নীতি প্রণেতারা এ কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সে কথারই পুনরুচ্চারণ করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে যখনই প্রশ্ন উঠেছে, তখনই এই মজবুত ভিত্তির অর্থনীতি শব্দবন্ধটি উল্লেখ করেছেন। এর আগে ২০১৩ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হারে ব্যাপক পতন দেখা গিয়েছিল, তখনও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এ কথাই বলেছিলেন।
আন্তর্জাতিক স্তরেও এ শব্দবন্ধ বেশ চালু।
এ শব্দবন্ধ ব্যবহারের অন্যতম কুখ্যাত উদাহরণ ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ঘটেছিল। সেদিন লেহম্যান ব্রাদার্স (ওয়াল স্ট্রিটের অন্যতম ব্রোকারেজ সংস্থা) লাটে ওঠে এবং সর্বতোভাবে আর্থিক সংকট ঘোষিত হয়। সে সময়ে রিপাবলিকদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, বর্তমানে প্রয়াত জন ম্যাকেইন বলেছিলেন মার্কিন অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত।
তার বছর খানেক আগে, ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন. দেশের আর্থিক ভিত্তি মজবুত। সে সময়ে হাউজিং মার্কেটের হাল ছিল খারাপ। বুশ এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
তাহলে, 'অর্থনীতির ভিত্তি' বলতে কী বোঝায়?
যখন কেউ অর্থনীতির ভিত্তির কথা উল্লেখ করেন, তখন অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। তার মধ্যে রয়েছে জিডিপি (প্রকৃত ও নমিনাল) বৃদ্ধির হার, সব মিলিয়ে বেরোজগারির হার, আর্থিক ঘাটতির মাত্রা, মার্কিন ডলারের তুলনায় সে দেশের মুদ্রার মান, অর্থনীতিতে জমা ও লগ্নির হার, মুদ্রাস্ফীতির হার প্রভৃতি।
যখনই অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে, তখনই অর্থনীতির এইসব ভিত্তির দিকে তাকানো এক ধরনের সহজাত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। সততার সঙ্গে এ বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করলে অর্থনীতির বেহাল অবস্থা কতটা গভীরে তার একটা অনুমান করা যায়। বর্তমান সংকট কতটা ক্ষেত্রগত সমস্যার অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া নাকি সত্যিই অর্থনীতি ভিত্তিগত ভাবেই সংকটে ও তার কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, উত্তর পাওয়া যায় সে প্রশ্নেরও।
বিএসই ৫০০-র মত বৃহত্তর স্টক ইনডেক্সের দিকে তাকালে ছবিটা আরেকটু স্পষ্ট হতে পারে। একইভাবে, বেশি দামি গাড়ির উৎপাদ বৃদ্ধি এবং সস্তা বিস্কুট প্যাকেটের চাহিদার গ্রাস বিশ্লেষণকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। কারণ এই বেশি বা কম মূলত ক্ষেত্র-ভিত্তিক বিষয়, অর্থনীতি ভিত্তিক বিষয় নয়।
অর্থনীতির সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে গেলে ভেরিয়েবলগুলির দিকেও সুদূরপ্রসারী নজর দেওয়া প্রয়োজন। একমাত্র তাহলেই সমস্যাগুলো কোথায় তাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
তাহলে ভারতীয় অর্থনীতির ভিত্তির বর্তমান অবস্থা কী?
প্রায় সব ভেরিয়েবেল থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে যে ভারতের অর্থনীতির হাল খারাপ।
প্রকৃত ও নমিনাল, দরকম বৃদ্ধির হারই ব্যাপক কমেছে, এখন যা অবস্থা তা বেশ কিছু দশকের মধ্যে নিম্নতম। রোজগারদায়ী আর্থিক বৃদ্ধির হার তার চেয়েও খারাপ, এবং যেসব ক্ষেত্র থেকে বেশি কর্মসসংস্থানের ঐতিহ্য রয়েছে, সেগুলির দুর্বলতাও ধরা পড়তে শুরু করেছে।
বেকারত্বের হারও কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বেশ কিছু হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১২ থেকে ১৮ সালের মধ্যে ভারতে রোজগারকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান- যা ভারতের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি।
আর্থিক ঘাটতি, যা সরকারি ফিনান্সের মাপকাঠি, খাতায় পত্রে সেখানে সব মোটামুটি ঠিকঠাক আছে জানালেও, এই সংখ্যাতত্ত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। ক্যাগ সহ অনেকেই বলেছে, সরকারিভাবে যা মেনে নেওয়া হয়, তার চেয়ে আর্থিক ঘাটতির হার অনেক বেশি থাকে।
এই ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতির পরিমাণ যথেষ্ট ভাল পর্যায়ে থাকলেও, ট্রেডের ক্ষেত্রে এবং ডলারের তুলনায় টাকার দামের ক্ষেত্রে দুর্বলতা কাটার কোনও নাম নেই। যদিও টাকা-ডলার সম্পর্কের ব্যাপারে এ কথা বলা যেতেই পারে যে টাকার মূল্য এখনও বেশি রাখা হয়েছে, যার ফলে ভারতের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।