এই জুনে উত্তর পাকিস্তানের প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকায়, সিন্ধু নদ পেরিয়ে এক বিশালকায় ক্রুশ আবিষ্কার করেছেন স্কারদুর বাল্টিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি দল। মার্বেল পাথরে তৈরি এই ক্রুশটি তিন থেকে চার টন ওজনের, উচ্চতা প্রায় ৭ ফুট। মনে করা হচ্ছে উপমহাদেশে যত ক্রুশ পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ।
এই আবিষ্কার সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে, কারণ এর জেরে উপমহাদেশের ধার্মিক ইতিহাসে নতুন আলো পড়েছে। কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে এই ক্রুশ ঠিক কোন সময়কার তা জানা এখন ও বাকি, তবে প্রাথমিক বিশ্লেষণ থেকে মনে করা হচ্ছে এটা একটি নেস্তোরিয়ান ক্রুশ, যা ৯০০ থেকে ১২০০ বছর আগের সময়ের। মনে করা হয় পূর্বে খ্রিস্টধর্মের শুরু হয়েছিল নেস্তোরিয়ানইজমে, যার সূত্রপাত এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ায়।
এ ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে বলেছেন এই ক্রুশটিতে বৌদ্ধ প্রভাব রয়েছে এবং মনে করা হচ্ছে এটি সেই সময়কালের যখন বৌদ্ধধর্ম এই এলাকা থেকে মুছে যাচ্ছে এবং নতুন খ্রিস্টিয় প্রভাব তার জায়গা নিচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ডট কমকে দেওয়া এক টেলিফোনিক সাক্ষাৎকারে কয়েদ-ই আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানি স্টাডিজের গবেষক ওয়াজিদ ভাট্টি বলেছেন "এটি একেবোরেই থোমানিয়ান ক্রুশ, যা যোগ চিহ্নের মত। থোমানিয়ান খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা সেন্ট টমাসের সঙ্গে যুক্ত, যিনি ছিলেন খ্রিস্টের ১২ শিষ্যের অন্যতম। পরে থোমানিয়ান খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিশে যান। উত্তর পাকিস্তানে বেশ কিছু নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টাবলম্বীদের বাস।"
এই গবেষক বলছেন এই ক্রুশের আবিষ্কারের ফলে উত্তর পাকিস্তানে উপনিবেশ স্থাপনের আগে খ্রিস্টধর্মের উপস্থিতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে। বাল্টিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রুশ আবিষ্কর্তা দলের এক সদস্য তথা ভাইস চ্যান্সেলর নহম্মদ নাদিম খানের কথায়, "হিমালয় কারাকোরাম পার্বত্য অঞ্চলের গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকার স্কার্দু উপত্যকায় এই ক্রুশের আবিষ্কার পাকিস্তান খ্রিস্টানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আত্মোপলব্ধি ও মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে এবং তাঁদের সঙ্গে পাকিস্তানে গভীর ঐতিহাসিক সংযোগেরও উপলব্ধি দেবে।"
বর্তমানে পাকিস্তানে হিন্দু ও খ্রিস্টানরা সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। এঁদের অধিকাংশ পাঞ্জাব প্রদেশে থাকেন। খানের কথায়, ক্রুশের আবিষ্কার পাকিস্তানের সঙ্গে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক সংযোগ বাড়াতে সাহায্য করবে। বাল্টিস্তানে এই ক্রুশ আবিষ্কারের ফলে পাকিস্তান ও পশ্চিমি বিশ্বের গবেষকদের মধ্যে সংযোগ বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
উত্তর পাকিস্তানে খ্রিস্টধর্ম
উত্তর পাকিস্তানে খ্রিস্টধর্মের জন্মের সঙ্গে যোগ রয়েছে বাণিজ্যের। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় ১৮ শতক পর্যন্ত সিল্ক রোড দিয়ে এই বাণিজ্য হত। চিন ও ভারত, পারস্য, পশ্চিম এশিয়া এবং দক্ষিণ ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যবস্তু সিল্ক এ পথে আনা-নেওয়া করা হত বলে এই নাম। তবে সিল্ক রোড দিয়ে সিল্ক ছাড়া আরও অন্যান্য পণ্যও আমাদনি রফতানি করা হত, এবং ২০০০ বছর ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংযোগকারী এই পথ।
এই সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে ব্যবসা ও বাণিজ্য। ধর্মীয় ইতিহাসবিদ ইয়ান গিলমান ও হানস জোয়াকিম ক্লিমকেইট তাঁদের বই খ্রিশ্চিয়ানস ইন এশিয়া বিফোর ১৫০০-তে লিথেছেন, ব্যাবসায়ী ও বাণিজ্যকারীদের সঙ্গেই সিল্ক রুটের পথে হেঁটেছেন রাজনৈতিক দূত ও সেনা, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট সহ নানা ধর্মের প্রচারক ও ভিক্ষু।
সিল্ক রোড দিয়ে ভ্রমণ ও বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এই পথ বরাবর বাসিন্দাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর। খ্রিস্টিয় প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টধর্ম দ্রুত ধর্মান্তরণে মন দেয় এবং তা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দৌলতে পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে।
খ্রিস্টিয় ধর্ম সিল্ক রুটে পা রেখেছিল নেস্তোরিয়ানইজমের হাত ধরে, যার প্রবক্তা ছিলেন নেস্তোরিসায়, পঞ্চম শতকের কনস্টান্টিনোপলের খোলামেলা মনোভাব রোমান ও বাইজান্টিয়ান বিশ্বকে খেপিয়ে দিয়েছিল। নেস্টোরিয়ানিজম পারস্য, ভারত ও চিনে ছড়িয়ে পড়েছিল সিল্ক রোড হয়ে।
ভাট্টির বিশ্লেষণ অনুসারে এই ক্রুশ নেস্তোরিয়ান খ্রিস্ট ধর্মের শুরুর সময়ের। তৃতীয় শতকে লিখিত অ্যাক্টস অফ টমাস এবং গসপেল অফ টমাস থেকে জানা যায়, ভারতে খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে সেন্ট টমাসের হাত ধরে খ্রিস্ট ধর্ম প্রবেশ করেছিল। যদিও ঐতিহাসিকরা এ ধরনের লিখিত বয়ানের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান, তা হলেও খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে ইন্দো পার্থিয়ান রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গন্ডোফারেসের কাছ থেকেও এর সমর্থন মেলে।
ভাট্টি জানিয়েছেন "আমার গবেষণার সময়ে স্থানীয় গ্রামবাসীরা আমাকে ওই এলাকায় সেন্ট টমাস প্রতিষ্ঠিত একটি গির্জার কথা জানিয়েছিলেন।"
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে ভারতের মালাবার উপকূলের সিরিয়ান খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের সঙ্গেও সেন্ট টমাসের যোগ রয়েছে।
পরবর্তী কয়েক শতকে নেস্টোরিয়ানইজম সিল্ক রুট ধরে উত্তর পাকিস্তানে বিকশিত হয় এবং সেখানকার থোমানিয়ান খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিশে ওই এলাকায় বাসস্থান তৈরি করে।
ডন সংবাদপত্রে নতুন আবিষ্কৃত ক্রুশ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফাদার গুলশন বরকত বলেছেন, পারস্য রাজ দ্বিতীয় শাপুর (৩০৯-৩৭৯) ৩৪০-এ তাঁর সাম্রাজ্যে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচার শুরু করেন।
করাচির ন্যাশনাল ক্যাথলিক ইনস্টিট্যুটের গির্জা ইতিহাসের অধ্যাপক বরকত লিখেছেন, "এমন হতে পারে যে পারস্য সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত কিছু খ্রিস্টান ও ধর্মপ্রচারক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে হিমালয় ও কারাকোরম উপত্যকায় শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের মধ্যে আশ্রয় নেন যা পরে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বসবাসের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।"
খানের কথায় গিলগিট ও স্কার্দু এলাকায় যথাক্রমে ১০০০ ও ৩০০ পাঞ্জাবি খ্রিস্টান বসবাস করেন। এঁরা গিলগিট বাল্টিস্তানে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের পর ওই এলাকায় এসেছেন।
উত্তর পাকিস্তানে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার
এই ক্রুশের আবিষ্কার পাকিস্তানে খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ জাগালেও, গিলগিট বাল্টিস্তান অঞ্চলে নেস্তোরিয়ান খ্রিস্ট ধর্মের প্রথম আবিষ্কার নয়।
ভাট্টি জানিয়েছেন টাক্সিলার কাছে সিরকাপ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলে ১৯৩৫ সালে আবিষ্কৃত ক্রুশের সঙ্গে এর প্রচুর মিল রয়েছে।
তিনি জানিয়েছেন দু জায়গাতেই নেস্তোরিয়ান খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর বাসের চিহ্ন রয়েছে। "একটি বাল্টিস্তানের ঘাঞ্চে জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এবং অন্যটি গ্রামের শেষ প্রান্তে। পাথরে খোদাই করা এই ক্রুশ আগে পাওয়া ক্রুশের মতই। এ ছাড়া এই গ্রামগুলিতে খ্রিস্টান নাম, গির্জা, সমাধি, এসবও মেলে যা এই এলাকার নেস্তেরিয়ান অতীতের জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।"