Advertisment

Explained: সন্ত্রাসমুক্ত দুনিয়া! জি২০-কে কোন পথে কাজে লাগাতে চাইছে ভারত?

ভারত নিজে সন্ত্রাসবাদের সমস্যায় জর্জরিত, তাই তার প্রয়োজনটাও বেশি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Terrorism

নয়াদিল্লিতে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে একটি খালি রাস্তায় টহল দিচ্ছেন নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ান। রাস্তার ধারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি-সহ জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের হোর্ডিং। (ছবি: রয়টার্স/অমিত ডেভ)

ভারত ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বজুড়ে ঐকমত্যের ওপর জোর দিচ্ছে। আর, একটি 'অভিন্ন, ঐক্যবদ্ধ এবং সহনশীলতাহীন দৃষ্টিভঙ্গি' তৈরি করতে চাইছে। যাইহোক, প্যারিস হামলার পর জি২০-তে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মতামত ২০২৫ সালেই জোরালো হয়ে উঠেছিল। এবার জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নয়াদিল্লিতে জড় হওয়ার সঙ্গেই ভারতের আশা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এজন্য আলোচনা এবং ঐকমত্য গঠন আরও সহজ হবে বলেই মনে করছে নয়াদিল্লি।

Advertisment

জি২০ সন্ত্রাসবাদের প্রতি কতটা মনোযোগী?

জি২০ হল বিশ্বের ২০টি বৃহত্তম অর্থনীতির একটি গোষ্ঠী। যা ১৯৯৯ সালে মূলত আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন রোখা এবং উন্নয়নের মত আন্তর্জাতিক অর্থনীতি সম্পর্কিত ব্যাপারে জোট তৈরি করেছিল। এই মঞ্চ প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তা সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দেখত। প্রথম দুটি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে (২০০৮ সাল থেকে জি২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরু করেছে) সন্ত্রাসবাদের কোনও উল্লেখ ছিল না।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

যাইহোক, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর-এর ঘটনার পর, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মার্কিন উপকূলে পৌঁছনোর সঙ্গেই আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মনোযোগ সেই দিকে চলে যায়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দীর্ঘকাল ধরেই ভারত এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু, মার্কিন উপকূলে পৌঁছনোর পর সেই বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের জি২০ বৈঠক তার বিবৃতিতে মোট ২৯ বার 'সন্ত্রাস', 'সন্ত্রাসবাদী' এবং 'সন্ত্রাস' প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছে। মূলত, ৯/১১ হামলার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের জেরে একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছিল। বিশেষ করে সন্ত্রাসে অর্থায়নের ব্যাপারে। এর ফলে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

তুরস্ক ও সন্ত্রাসবাদ

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কৌশলগত অধ্যয়ন কর্মসূচির ফেলো কবীর তানেজা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, '২০০৮ সালে যখন জি২০-র প্রথম শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, তখন সন্ত্রাসবাদ মোটেও মূল বিষয় ছিল না। এটি প্রধানত একটি অর্থনৈতিক মঞ্চ হওয়ায়, এর মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে কোনও বিতর্ক তৈরি হয়নি। যাইহোক, ২০১৫ সালে জি২০-তে তুরস্কের সভাপতিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। সেই সময় তুরস্ক সিদ্ধান্ত নেয় যে তার জাতীয় এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য এটি (সন্ত্রাসবাদ) একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।' টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জি২০ রিসার্চ গ্রুপের গবেষণা বিশ্লেষক ক্যাথরিন ইয়াম্পলস্কির একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, জি২০ নেতারা ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোট ৪৮টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাদের কথোপকথনে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোট ৬,৪৬৯টি শব্দ ব্যবহার করেছেন।

জঙ্গিপনা এবং জি২০-র দৃষ্টিভঙ্গি

২০০১ সালের পরে, ২০১৫ সালে তুরস্কের শীর্ষ সম্মেলনের আগে, যখন শীর্ষ সম্মেলনের নথি তৈরি করা শুরু হয়েছিল, তখন তাতে সন্ত্রাসবাদের তেমন কোনও উল্লেখ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ২০০২ সালের বৈঠকে 'সন্ত্রাস' শব্দের মাত্র তিনটি উল্লেখ ছিল। যা সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে 'নতুন প্রতিশ্রুতি'-র বাইরে কোনও উল্লেখযোগ্য দাবি জানায়নি। প্যারিস হামলা এবং ইসলামিক স্টেটের উত্থানের পর তুরস্কের শীর্ষ বৈঠক ফের বিষয়টি তুলে ধরেছিল। আর, এক্ষেত্রে 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার সমস্ত রূপ এবং যেখানেই এটি (সন্ত্রাস) ঘটবে, তার সমাধান' করার জন্য শীর্ষ সম্মেলনের বিবৃতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, জি২০ নেতারা সন্ত্রাসের নিন্দা ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছেন। ২০১৭ সালের হামবুর্গে, জি২০ নেতারা 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি' দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে ওসাকায় তাঁরা সন্ত্রাসবাদ এবং হিংসার বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে নজরদারি সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনাভুক্ত করেছিলেন।

এই আলোচনায় ভারতের ভূমিকা কী?

ভারত জি২০-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। জি২০ গোষ্ঠী এই বিষয়ে খুব কম অর্জন করেছে। ওআরএফ মুম্বইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর তথা সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ফেলো ড. সমীর পাতিলের অভিযোগ, আজ পর্যন্ত জি২০ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আলোচনা ছাড়া বিশেষ কিছুই অর্জন করতে পারেনি। তবে গত একবছরে, ভারত জি২০-তে সন্ত্রাসবাদকে ফোকাস করতে সক্ষম হয়েছে। এটি বিশ্ব অর্থনীতি এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেছে। নিরাপত্তার ওপর নতুন যুগের প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আয়োজিত জুলাই জি২০ সম্মেলনটিও প্রশংসনীয় ছিল। কারণ, এই গোষ্ঠী মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং শাসনের ওপর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। পাটিল জানিয়েছেন, গত একবছরে ভারত ইন্টারপোল, জাতিসংঘ এবং নো মানি ফর টেরর কনফারেন্সের স্তরে তিনটি সম্মেলন আয়োজন করেছে। সেখানে উদীয়মান প্রযুক্তির কারণে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং প্রচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জি২০ কি সন্ত্রাসের উদ্বেগ মোকাবিলার সঠিক মঞ্চ?

তানেজার মতে, যেহেতু সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতি নিজেই পরিবর্তিত হচ্ছে, এমনকী জি২০-এর মত একটি মঞ্চও এটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারছে না। তানেজা বলেন, 'আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে আজকে সন্ত্রাসবাদ দ্রুত বিকশিত হয়েছে। বিশেষ করে গত এক দশকে এই বিকাশ আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এটি কেবল আল কায়েদা বা ৯/১১-পরবর্তী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এজেন্ডার মতো গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপার নয়। বরং, আমরা কীভাবে ভূ-অর্থনীতির যুগে সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থাকে দেখি, এই প্রকল্পগুলোর সুরক্ষা থেকে শুরু করে ডিজিটাল পরিকাঠামো, সাইবার স্পেসের সুরক্ষা-সহ সমস্ত বিষয়ই সন্ত্রাসের আলোচনায় উঠে এসেছে। বন্দর থেকে শুরু করে ক্রিপ্টোকারেন্সি পর্যন্ত, সন্ত্রাসবাদ আজ প্রতিটি কাঠামো ব্যবহার করে।' এমনটাই জানিয়েছেন তানেজা। তাঁর অভিযোগ, আফগানিস্তানের মতো ইস্যু এখন আন্তর্জাতিক আলোচ্যসূচি থেকে বাদ পড়েছে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা- উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারতের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে সন্ত্রাস। তবে, আঞ্চলিক বা জাতীয় সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে বাস্তব বা কৌশলগত ফলাফল আশা করার জন্য জি২০ মোটেও সঠিক মঞ্চ নয়। তবে, এটি নয়াদিল্লির ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যপূরণে সহায়ক এবং গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন তানেজা।

আরও পড়ুন- জি২০-র স্থায়ী সদস্য আফ্রিকান ইউনিয়ন: তাতে ভারতের কী লাভ হবে?

জি২০ থেকে ভারত কী আশা করতে পারে?

ভারত ইতিমধ্যে মার্চ মাসে বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে দুটি জি২০ সম্মেলনে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আয়োজিত সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, 'সন্ত্রাসী উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে নতুন এবং উদীয়মান প্রযুক্তি' ব্যবহার, 'সন্ত্রাসবাদ এবং সংগঠিত অপরাধের মধ্যে সংযোগ', 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয় চূর্ণ করা', 'ডিজিটাল পাবলিক পরিকাঠামো সুরক্ষিত করা', 'ডার্কনেট এবং ক্রিপ্টো-কারেন্সি দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ' এবং 'মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন প্রতিরোধে সম্মিলিত ব্যবস্থা।' পাটিলের মতে, ভারত আশা করবে যে তার দ্বারা উত্থাপিত কিছু উদ্বেগ শীর্ষ সম্মেলনেও স্থান পাবে। ভারত জানে যে জি২০ মঞ্চ সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভাঙার চেয়ে সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন প্রতিরোধে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই গত একবছর ধরে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চের মাধ্যমে ভারত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর অর্থরোধ এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

India Terrorism USA Turkey G-20 Summit
Advertisment