সাম্প্রতিকতম বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২-তে। গত বছর ভারতের স্থান ১০৩ নম্বরে ছিল বটে, কিন্তু সেবার হিসেব হয়েছিল ১১৯টি দেশের মধ্যে। ফলে এ বছরের পর্যায়ক্রমে এক ধাপ উপরে উঠলেও তুলনামূলক বিচারে অন্য দেশগুলির তুলনায় ভারতের স্থান মোটেই বাল নয়। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ক্ষুধার হিসেব করা হয়, নিম্ন, সহনীয়, গুরুতর, বিপজ্জনক এনং অতি বিপজ্জনক। ভারতের অবস্থান ক্ষুধার মাত্রায় গুরুতর অবস্থানে। বিশ্বের আরও ৪৬টি দেশের সঙ্গে এক পংক্তিতে রয়েছে এ দেশ।
সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে ২০১৫ সালে যেখানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৮৫ মিলিয়ন, সেখানে এবার তা বেড়ে হয়েছে ৮২২ মিলিয়ন। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে "বেশ কিছু দেশের ক্ষুধার মাত্রা এখন ২০১০ সালের উপরে এবং প্রায় ৪৫টি দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধাসূচক নিম্নস্তরে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হবে।"
বিশ্ব ক্ষুধা সূচক কী?
২০০০ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই ক্ষুধা সূচক প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ বছরের সূচক চতুর্দশতম। এ সূচকে যার মান যত কম, তার ক্রম তত উঁচুতে, অর্থাৎ তাদের পারফরম্যান্স তত ভাল।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অর্থনীতির নোবেলজয়ীদের কাজকর্মের খুঁটিনাটি
ক্ষুধার পরিমাপ করার কারণ হল, ২০৩০-এর মধ্যে ক্ষুধাশূন্য পৃথিবী চায় রাষ্ট্র সংঘ। সে কারণে উচ্চ আয়ের দেশগুলিকে বিশ্ব ক্ষুধাসূচকের আওতায় আনা হয় না।
সাধারণভাবে ক্ষুধাকে খাদ্যাভাব দিয়ে বিচার করা হলেও, আনুষ্ঠানিক ভাবে এর পরিমাপ করা হয় ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রার উপর নির্ভর করে।
কিন্তু বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ক্ষুধার সংকীর্ণ সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ নয়। তার বদলে বিভিন্ন দেশের চারটি নির্দিষ্ট প্যারামিটারকে একসঙ্গে হিসেব করা হয়। এই প্যারামিটারগুলি বিভিন্ন প্রেক্ষিতকে বুঝতে সাহায্য করে, যার ফলে ক্ষুধার একটি ব্যাপকতর হিসেব করা সম্ভব হয়।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে কীভাবে ক্ষুধার পরিমাপ করা হয়?
প্রতিটি দেশের জন্য চারটি নির্দিষ্ট সূচকের হিসাব করা হয়
* অপর্যাপ্ত পুষ্টি (যা পর্যাপ্ত খাদ্যের অপ্রতুলতাকে প্রতিফলিত করে), তার হিসেব করা হয় জনসংখ্যার কত অংশ অপর্যাপ্ত পুষ্ট (অর্থাৎ, ক্যালোরি গ্রহণ অপর্যাপ্ত);
* শিশুদের ক্ষয় (Child Wasting) যা অতি অপুষ্টির নির্ণায়ক- এর হিসেব করা হয় পাঁচ বছরের নিচের কত পরিমাণ শিশুর ওজন তাদের উচ্চতার অনুপাতে কম তার নিরিখে
* শিশুদের বৃদ্ধিরোধ (যা দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির নির্ণায়ক)- এর হিসেব করা হয় পাঁচ বছরের নিচের কত শিশুর উচ্চতা তাদের বয়সের অনুপাতে কম, তার নিরিখে
* শিশুমৃত্যু (যা একইসঙ্গে অপর্যাপ্ত পুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের নির্ণায়ক)- এর হিসেব করা হয় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হারের নিরিখে।
প্রতিটি দেশের তথ্য ১০০ পয়েন্ট স্কেলের উপর দাঁড়িয়ে হিসেব করা হয়। এই ১০০ পয়েন্টের মধ্যে প্রথম ও চতুর্থ বিভাগে থাকে ৩৩.৩৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগকে ১৬.৬৬ শতাংশ।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অযোধ্যা মামলায় মোড়- কাকে বলে ওয়াকফ?
যেসব দেশের স্কোর ৯.৯ শতাংশ বা তার চেয়ে কম, তাদের "নিম্ন" বিভাগে রাখা হয়, যাদের স্কোর ২০ থেকে ৩৪.৯- তাদের "গুরুতর" বিভাগে রাখা হয়। যাদের স্কোর ৫০-এর বেশি সেসব দেশগুলি "অতি বিপজ্জনক" বিভাগে পড়ে।
অন্যদের তুলনায় ভারতের স্কোর কীরকম?
ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান সবচেয়ে নিচে। দক্ষিণ এশিয়াতেও ভারত অন্য সব দেশের পিছনে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান, সকলেই ভারতের আগে রয়েছে।
ভারতের চেয়ে ভাল অবস্থানে অন্য যে দেশগুলি রয়েছে তাদের মধ্যে আছে সৌদি আরব (ক্রম ৩৪), ভেনেজুয়েলা (ক্রম ৬৫, যদিও তাদের আর্থ-সমাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে তাদের স্কোর এবার ৮ থেকে দ্বিগুণ হয়ে ১৬তে দাঁড়িয়েছে), লেসোথো (ক্রম ৭৯), বুরকিনা ফাসো (ক্রম ৮৮) এবং উত্তর কোরিয়া (ক্রম ৯২)।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও তাদের আগে রয়েছে আফগানিস্তান, হাইতি অথবা ইয়েমেনের মত দেশ, যাদের প্রশাসনের হাল অতি খারাপ, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তছনছ হয়ে গিয়েছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের মান এত নিচে কেন?
সব মিলিয়ে ভারতের স্কোর ৩০.৩। ভারতের অবস্থান নাইজের (স্কোর ৩০.২, ক্রম ১০১) এবং সিয়েরা লিওন (স্কোর ৩০.৪, ক্রম ১০৩)-এর মাঝে। ভারতের স্কোর ২০০০ সালে ছিল ৩৮.৮ এবং ক্ষুধার মাত্রা ছিল "বিপজ্জনক" বিভাগে। তার পর থেকে ভারত প্রায় সব বিভাগেই উন্নতি ঘটিয়ে এখন "গুরুতর" বিভাগে এসে পৌঁছিয়েছে।
কিন্তু ভারতের উন্নতির হার অত্যন্ত ক্ষীণ। নাইজের এবং সিয়েরা লিওনের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০০০ সালে তাদের স্কোর ছিল যথাক্রমে ৫২.১ এবং ৫৩.৬ এবং তারা ছিল "অতি বিপজ্জনক" বিভাগের অন্তর্ভুক্ত- এবং তাদের হাল ছিল ভারতের চেয়ে অনেক খারাপ।
ফলে ভারত নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটালেও আরও অনেকে অনেক বেশি উন্নতি ঘটিয়েছে এবং এ থেকে স্পষ্ট যে ২০০০ সাল থেকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার অনেক দ্রুত হলেও দেশের ক্ষুধা কমানোর ব্যাপারে এ দেশ তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
ভারতের উন্নতির হার এত ক্ষীণ হবার কারণ কী?
একটা বড় বিষয় হল, শিশুক্ষয় বা চাইল্ড ওয়েস্টিংয়ের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান খারাপ হয়েছে। ২০১০ সালে যে হার এ বিভাগে ছিল ১৬.৫, তা এখন বেড়ে হয়েছে ২০.৮। অর্থাৎ বয়সের তুলনায় কম ওজনসম্পন্ন পাঁচ বছরের নিচের শিশুর শতকরা হারের বৃদ্ধি ঘটেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, "ভারতের শিশুক্ষয়ের পরিমাণ ২০.৮ শতাংশ, সব দেশের চেয়ে বেশি। শিশুদের বৃদ্ধিরোধের হার ভারতে ৩৭.৯ শতাংশ, যা জনস্বাস্থ্যের তাৎপর্যের দিক থেকে হিসেব করলে খুবই বেশি... ভারতে ৬ মাস থেকে ২৩ মাস পর্যন্ত বয়সী শিশুদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য দেওয়া হয়ে থাকে।"
আরও বলা হয়েছে, "২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বচ্ছ ভারত প্রচার অভিযান শুরু করেন খোলা জায়গায় মলত্যাগ বন্ধ করা এবং সমস্ত বাড়িতে শৌচাগার নিশ্চিত করতে। কিন্তু শৌচাগার নির্মিত হলেও জনসাধারণের স্বাস্থ্য এবং শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং তাদের পুষ্টিগ্রহণের ক্ষমতা বাড়েনি।"
Read the Full Story in English